রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মতিঝিলের ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থী মো. সালমান ফার্সি এবারের এসএসসি পরীক্ষায় একটি বিষয় বাদে সব বিষয়েই ‘এ প্লাস’ পেয়েছে। শুধু ইংরেজি প্রথম পত্রে পেয়েছে ৬০ নম্বর। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রেও সে পেয়েছে ৯২ নম্বর। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই স্কুলের ইংরেজি ভার্সনেরই মোট ১৬ জন শিক্ষার্থী ইংরেজি প্রথম পত্রে কম নম্বর পেয়েছে। অথচ অন্য সব বিষয়েই তারা ‘এ প্লাস’ পেয়েছে। রোববার (১৯ মে) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।
এ অবস্থায় গত ৮ মে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম ১৬ জন শিক্ষার্থীর ইংরেজি প্রথম পত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছেন। চিঠিতে লেখা হয়েছে, এই ১৬ শিক্ষার্থীর প্রত্যেকে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে ৮০ নম্বরের ওপরে পেলেও ইংরেজি প্রথম পত্রে ৫৫ থেকে ৬৪-এর মধ্যে নম্বর পেয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে ওই শিক্ষার্থীদের একজনের অভিভাবক বলেন, ‘আমার সন্তান ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষার্থী। সে নম্বর কম পেলে অন্য বিষয়ে পাবে। কিন্তু ইংরেজি প্রথম পত্রে সে ৮০-র নিচে নম্বর পাবে, তা শিক্ষকরাও চিন্তা করেন না।’
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষার্থী ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে ৮০-এর ওপরে নম্বর পেলেও প্রথম পত্রে ৬০-এর কাছাকাছি পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করেছে। দেখা যাক, সেখানে কী হয়। এখন যিনি খাতা দেখেন, তাঁর প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। কিন্তু তাঁকেও মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখে এই আস্থার প্রতিদান দিতে হবে।’
রাজধানীর আরেকটি স্বনামধন্য স্কুলের এক শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তবে তার নম্বরপত্রে দেখা যায়, ১২টি বিষয়ের মধ্যে ১১টিতে সে ‘এ প্লাস’ পেয়েছে। শুধু ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ‘এ’ পেয়েছে। এই বিষয়ে তার প্রাপ্ত নম্বর ৭৭। সে উচ্চতর গণিতে ১০০, গণিতে ৯৮, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৬ নম্বর পেয়েছে। অন্য সব বিষয়ে নম্বর পেয়েছে ৯০-এর ওপরে।
নাম প্রকাশ না করে ওই শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, ‘আমার মেয়ের রোল নম্বরের নিচের অন্তত ২০ জন গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে, কিন্তু সে না পাওয়ায় রেজাল্টের পর থেকেই শুধু কান্নাকাটি করছে। আমি নিশ্চিত, পুনরায় খাতা দেখা হলে সে ধর্মেও ৮০-এর ওপরে নম্বর পাবে। কিন্তু শুনলাম, পুনর্নিরীক্ষায় শুধু নম্বর যোগ বা বিয়োগ করে দেখা হয়। তাহলে এ কেমন পুনর্নিরীক্ষা?’
চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় শুধু ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেই এক লাখ ৪০ হাজার ৯২৩টি খাতা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন পড়েছে। আর আবেদনকারীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ৭০ জন। গত বছরও এই বোর্ডে এক লাখ ৩৮ হাজার খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। সেখান থেকে এক হাজার ৯৯০ জনের ফলও পরিবর্তন হয়।
আর এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সারা দেশে তিন লাখ ৬৯ হাজার খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন পড়েছে। প্রতিটি খাতা বাবদ শিক্ষার্থীদের ফি দিতে হয়েছে ১২৫ টাকা। সেই হিসাবে এই খাতা থেকেই বোর্ডগুলোর আয় হবে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। কিন্তু এত টাকা আয় করেও শুভংকরের ফাঁকি রেখেই খাতা পুনর্মূল্যায়নের কাজ শেষ করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মনে করছেন, ফল পুনর্নিরীক্ষণের অর্থ নতুন করে খাতা দেখা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। ফল পুনর্নিরীক্ষণে সাধারণত চারটি দিক খেয়াল করা হয়। সব প্রশ্নের উত্তরে নম্বর সঠিকভাবে দেওয়া হয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক হয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিটে তোলা হয়েছে কি না এবং নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটের বৃত্ত ভরাট ঠিক আছে কি না। তবে উত্তরপত্র পুনরায় মূল্যায়ন করা হয় না। অর্থাৎ কোনো শিক্ষার্থী কোনো প্রশ্নে নম্বর কম বা বেশি পাবে কি না, তা দেখা হয় না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নম্বর যোগ-বিয়োগের ভুলেই প্রতিবছর একেকটি পাবলিক পরীক্ষায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে পুনরায় খাতা দেখলে আবেদনকারীদের বেশির ভাগেরই ফল পরিবর্তন হতো। পরীক্ষকদেরও আরো কয়েক গুণ ভুল ধরা পড়ত।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, ভালো পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষকদের অবহেলা ও অদক্ষতায় শিক্ষার্থীরা যথাযথ ফল পাচ্ছে না। অনাকাঙ্ক্ষিত ফল বিপর্যয়ের শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে, এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু যাঁদের কারণে এই বিপর্যয়, দায়ী সেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না। এতে অন্য পরীক্ষকরাও সতর্ক হচ্ছেন না।
জানা যায়, খাতা মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছে ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীরা। কারণ ইংরেজি ভার্সনে যাঁরা পড়াচ্ছেন তাঁদের বেশির ভাগই দক্ষ নন। অনেক বাংলা ভার্সনের শিক্ষককেও অনেক সময় ইংরেজি ভার্সনের ক্লাস নিতে বাধ্য করছে স্কুলগুলো। আর তাঁরাই খাতা দেখছেন। এমনকি বর্তমানে ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নও সরাসরি করা হয় না। কারণ দক্ষ শিক্ষকের অভাব। বাংলা ভার্সনের প্রশ্নই ইংরেজিতে অনুবাদ করে এখনো পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হয়।
নীতিমালা অনুযায়ী প্রধান পরীক্ষক হওয়ার জন্য ১০ বছর এবং পরীক্ষক হওয়ার জন্য পাঁচ বছর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানপ্রধান সম্মতি দিলেই একজন শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন পরীক্ষক। জুনিয়র সেকশনের শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন মাধ্যমিকের পরীক্ষক, কলেজের শিক্ষকরাও মাধ্যমিকের পরীক্ষক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আবার কোনো শিক্ষক যদি স্বল্প সময়ের জন্যও কোনো একটি বিষয়ে পড়ান, তাহলেও তিনি ওই বিষয়ে খাতা দেখার আবেদন করতে পারছেন। এভাবেই এক বিষয়ের শিক্ষক হয়েও অন্য বিষয়ের পরীক্ষক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরা। এসব শিক্ষক সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করতে পারছেন না।
এ ছাড়া প্রধান পরীক্ষকও অনেক সময় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না। কারণ ১০ শতাংশ খাতা তাঁর নিজেরই পুনরায় চেক করার কথা। কিন্তু তা না করেই খাতা জমা দিয়ে দেন অনেক প্রধান পরীক্ষক।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘পরীক্ষার ফলের পর সাধারণত কিছু শিক্ষার্থীর বিচ্ছিন্ন অভিযোগ থাকে। তবে ১ জুন পুনর্নিরীক্ষার ফল দেওয়া হবে। এতে অনেকটাই সমস্যার সমাধান হবে। পরীক্ষকরা যাতে সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করেন সে জন্যও আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি।’
উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট। এই সংস্থার প্রধান ও ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ (পরীক্ষা ও মূল্যায়ন) রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, ‘এখন খাতা মূল্যায়নে মডেল উত্তরপত্র দেওয়া হয়। পরীক্ষকদের ছয় দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রায় ৬০ হাজার পরীক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে দীর্ঘদিন প্রয়োজন। এ জন্য আমরা এরই মধ্যে অনলাইনে প্রশিক্ষণ শুরু করেছি। খাতা মূল্যায়নে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে যাঁরা সিনসিয়ারলি খাতা দেখেন না, তাঁদের আমরা যতই প্রশিক্ষণ দিই আর মডেল উত্তরপত্র দিই তাদের ত্রুটি থেকেই যাচ্ছে।’