ওপেন বুক পরীক্ষা পদ্ধতিতে মূল্যায়ন - দৈনিকশিক্ষা

ওপেন বুক পরীক্ষা পদ্ধতিতে মূল্যায়ন

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

শিক্ষার্থী মূল্যায়ন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া যা শিখন-শেখানো বিষয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফেস টু ফেস মোডে শিখন-শেখানো কার্যক্রমটি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিকল্প পদ্ধতিতে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের ফলপ্রসুতা যাচাই করার কথা ভাবা হচ্ছে। অনলাইন বা অফলাইনে, যেভাবেই হোক পরীক্ষার মাধ্যমেই দেশের বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেট পাওয়া উচিত বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল্যায়নের জন্য ‘ওপেন বুক এক্সাম’ পদ্ধতি গ্রহণ করে আসছে। যদিও অ্যাসাইনমেন্ট রাইটিং, প্রজেক্ট প্রস্তুতি, গ্রুপ ওয়ার্ক, অনলাইনে মৌখিক পরীক্ষা, ইত্যাদি পদ্ধতিও সার্বিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

শিক্ষাবিদদের একাংশের যুক্তি, নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্দিষ্ট মাত্রায় দখল না থাকলে বই দেখেও কোনো পডুয়া সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না। কারণ, উচ্চশিক্ষায় বিষয়ের ওপর স্বচ্ছ ধারণা রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই বই দেখে উত্তর লেখা হলেও, তা বিভিন্ন পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হবে। পরীক্ষকরা তার মূল্যায়নও যথাযথভাবে করতে পারবেন। অফলাইনে নয়, অনলাইনেই পরীক্ষা নেয়া হবে। আর থাকবে হোম অ্যাসেসমেন্ট। তবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমেও পড়ুয়াদের পরীক্ষা নিতে পারবেন। এই মুহূর্তে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরীক্ষা নিতে হলে এটাই একটা ভালো উপায়।

মূলত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যাতে পরীক্ষা নেয়া যায় সেই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। কোন তারিখে কোন বিষয়ের পরীক্ষা নেয়া হবে সেই বিষয়ে বিস্তারিত গাইডলাইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, কোন ই-মেইল আইডিতে উত্তরপত্র আপলোড করে পাঠাবেন শিক্ষার্থীদের সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। তার সঙ্গে প্রশ্নপত্র পাওয়ার কতোক্ষণের মধ্যে শিক্ষার্থীরা উত্তরপত্র ফেরত দেবেন সে বিষয়ও গাইডলাইনে বলা থাকবে ।

ওপেন বুক পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে পাঠ্যবই, নোটবুক ও সম্পর্কিত রিডিং ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয় ফলে এই পদ্ধতি স্মৃতি এবং অসংগঠিত তথ্যকে সুসংগঠিত করার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে পাঠ্যপুস্তকটির প্রতিটি পৃষ্ঠাকে মনে রাখতে হবে, কোন প্রশ্নটির উত্তর কোথায় আছে বা থাকার সম্ভাবনা আছে তা ভালোভাবে আত্মস্থ করতে হবে। উন্মুক্ত পরীক্ষা পদ্ধতিতে  শিক্ষার্থীরা বাসায় বই নিয়ে যেতে পারে কিংবা বাসায় বসে পরীক্ষা দিতে পারে। মুখস্থবিদ্যা নির্ভর পরীক্ষার চেয়ে এই পদ্ধতি বেশি কার্যকর। এটি শিক্ষার্থীদের দ্রুত কোনো তথ্য বের করার দক্ষতা, বুঝতে পারা, বিশ্লেষণ করার দক্ষতা এবং অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি করে এবং শিক্ষার্থীদের সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতাও পরীক্ষা করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তর দেয়া মানে বই থেকে শুধু তথ্যের নকল নয়। এখানে শুধু উত্তর বের করাটাই ক্রেডিট নয় বা বেশি নম্বর পাওয়ার বিষয়ও নয়। বরং কীভাবে তারা তথ্যটি খুজঁছেন, কীভাবে প্রয়োগ করছেন ও বিশ্লেষণ করছেন সেগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

যতোটা মনে করা হয়, ওপেন বইয়ের পরীক্ষা ততোটা সহজ নয়। কখনো কখনো বদ্ধ বুক পরীক্ষার তুলনায় এটি আরো কঠিন। ওপেন বুক পরীক্ষার জন্য সময় নির্ধারিত থাকে। যদি শিক্ষার্থীরা বইগুলোর সঙ্গে পরিচিত না হন, নোটগুলো পড়ার পরেও যদি মনে রাখতে না পারেন তবে খোলা বইয়ের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারবেন না। খোলা বই পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে যে বিষয়টি বুঝতে হবে তা হলো বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যে জ্ঞান প্রয়োগ করার ক্ষমতা দরকার সেদিকে খেয়াল রাখা। পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আরো সৃজনশীল এবং যত্নশীল  হতে হবে। 

ওপেন বুক পরীক্ষায় পাঠ্যপুস্তক এবং সংশ্লিষ্ট কার্যপদ্ধতি, রির্সোস ম্যাটেরিয়েলস বা নোটবুকে উল্লেখ আছে এমন বিষয়ে প্রশ্ন করতে হয়; শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োগ করতে হয়; শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, চিন্তন দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, বুদ্ধিবৃত্তিক উপযুক্ততা যাচাই, নমনীয়তা সমুন্নত করা এবং সমস্যা সমাধানে পারদর্শিতা পরিমাপ করা হয়; শিক্ষার্থীকে পড়ানো হয়েছে বা সিলেবাসে আছে এর যেকোনো স্থান থেকে প্রশ্ন করা হয়; পরীক্ষার জন্য নিজে কর অনুশীলন করার প্রয়োজন হয়, এজন্য বই, নোট ও সহায়ক ম্যাটারিয়েলস সংগঠিত ও নিশ্চিত করার অনুমতি দেয়া হয়। 

বই এবং অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ সামনে নিয়ে পরীক্ষার নেয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সৃজনশীলতাকে উস্কে দেয়া আর মুখস্থ করাকে নিরুৎসাহিত করা। এটি করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যে বিভিন্ন বই ও উৎস থেকে উত্তর খুঁজেন, পড়াশুনা করেন, আলোচনা করেন, তাতে শিক্ষার্থীদের ধারণাসমূহ একটির সঙ্গে আরেকটি মেলানো ও তুলনা করার সুযোগ হয়, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, জ্ঞানের পরিসীমা বিস্তৃত হয়, রিজনিং ফ্যাকাল্টি ধারালো হয়। এ ধরনের পরীক্ষা শিক্ষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যিনি প্রশ্ন তৈরি করবেন, তাকে মাথায় রাখতে হবে, মুখস্থবিদ্যা বা রেডিমেড নোট কাজে লাগিয়ে যেনো উত্তর দেয়া না যায়। চিরাচরিত ধাঁচে সাধারণ প্রশ্ন হলে মূল্যায়ন ঠিক হবে না। এমন প্রশ্ন করা দরকার যার উত্তর হবে ক্রিটিক্যাল অর্থাৎ বিষয় না বুঝে লেখা যাবে না। ওপেন বুক এক্সাম-এর জন্য ছাত্রকে প্রস্তুত করতে হলে শিক্ষককে অনেক ভাবতে হবে। তবে এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষকদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ দরকার।

উন্নত দেশের শিক্ষাদানের পদ্ধতি আমরা যখন অনুসরণ করছি, তখন পরীক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করতে দোষ কোথায়? যিনি প্রশ্ন তৈরি করবেন, তাকে মাথায় রাখতে হবে, মুখস্থ বিদ্যা কাজে লাগিয়ে যেনো উত্তর দেয়া না যায়। যে পড়ুয়া বিষয়ের গভীরে পড়াশোনা করেছেন, এই পদ্ধতিতে তার সঠিক মূল্যায়ন হবে। শিক্ষার্থীদেরকে জানতে ও শিখতে হবে কীভাবে তথ্য পেতে হয়। অধ্যায়সমূহ ভালোভাবে পড়তে হবে এবং কোন অধ্যায়ে কী কী বিষয় রয়েছে তা ভালো করে আত্মস্থ করতে হবে; পরীক্ষার সময় দ্রুত উত্তর খুঁজে নিতে হলে প্রশ্নের সঙ্গে অধ্যায়ের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে নিতে হবে; সবার আগে প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট অধ্যায়, শিরোনাম এবং উপ-শিরোনাম মিলিয়ে নিজস্ব রূপরেখা তৈরি করে নিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্টিকি নোট এবং পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করে নেয়া যেতে পারে; থিমগুলোর জন্য বক্তব্য নোট পর্যালোচনা, শিক্ষকের বক্তৃতাগুলো এবং নিজের ধারণাগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ লেখা; সবসময় একা একা বই না পড়ে পর্যালোচনা করা; অনলাইনে সহপাঠিদের সঙ্গে আলোচনা করা; নিজে নিজে পড়ে নিজস্ব নোট তৈরি করা; অনেক সময় পাঠ্য বইয়ের কোন অনুচ্ছেদে প্রশ্নের উত্তর প্রদর্শিত হবে না তাই যথাযথ উত্তর লিখতে হলে সম্পূর্ণ অধ্যায় পড়া। তা ছাড়া বরাদ্দকৃত সময়ে প্রশ্নের ভালো উত্তর দিতে বা যথার্থ তথ্য খুঁজে পেতে হলে পর্যাপ্ত পড়াশুনা করা। প্রশ্নের মৌলিক উত্তর জানা থাকতে হবে এবং পরীক্ষার সময়, বই থেকে তথ্য সন্ধান করে যথার্থ উত্তরটি লিখতে হবে; ওপেন বুক পরীক্ষার প্রশ্নগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিষয়ের ব্যাখ্যা, মূল্যায়ন বা তুলনা করতে বলা হয়; এই ক্ষেত্রে শিক্ষক ব্লুমস টেক্সনোমি অনুসরণ করতে পারেন। বর্তমানে পেন-পেপার টেস্ট এ জ্ঞানমূলক প্রশ্নে ২০ নম্বর, কম্প্রিহেনসিভ ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং প্রশ্নের উত্তরে ২০ নম্বর, অ্যাপ্লিকেশন প্রশ্নের উত্তরে ২০ নম্বর এবং উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্নে ৪০ নম্বর বন্টন করা হয়। এই পদ্ধতিতে উচ্চতর দক্ষতার ক্ষেত্রকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ওপেন বুক পদ্ধতির সবচেয়ে বড় উপকার হচ্ছে শিক্ষার্থী না বুঝে তথ্য মুখস্থ করার অভ্যাস পরিত্যাগ করবে। এক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা হবে একটি আনন্দঘন কাজ। আনন্দের মাধ্যমে যা শেখা যায় বা শেখানো যায় তা অধিক কার্যকরী। এটিকে বাস্তব জীবনে সহজে প্রয়োগ করা যায়।

ক্লোজড বুক পরীক্ষা পদ্ধতি খোলা বইয়ের পরীক্ষার ঠিক উল্টো। সাধারণত এমন উপায়ে শিক্ষার্থীদের বই, নোট কিংবা অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ কাছে থাকে না। পাঠ্যপুস্তক বা সংশ্লিষ্ট কার্যপদ্ধতি বা যে যে বিষয়ে যা অধ্যয়ন করেছেন তা মনে রেখে পরীক্ষায় লিখতে হবে। ক্লোজড বুক পরীক্ষায়, শিক্ষক সরাসরি তদারকি ও পরিবীক্ষণ কার্যক্রমে সহায়তা করে থাকেন; পাঠ্যপুস্তুক বা নোটবই যা পূর্বে পড়ানো হয়েছে বা শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে সেগুলো বন্ধ করে পরীক্ষা নিয়ে মেধা যাচাই করা হয়; শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে অনেকক্ষেত্রে না বুঝেই পরীক্ষার খাতায় লিখে থাকেন; শিক্ষার্থীরা কতটুকু তথ্য সামগ্রী তার মস্তিষ্কে সংরক্ষণ করতে পেরেছেন তা লেখনির মাধ্যমে যাচাই করা হয়। শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কের মধ্যে সংরক্ষিত তথ্য বা এর পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়; শিক্ষার্থীরা যা যা শিখেছেন তা স্মরণ রেখে উত্তর লিখতে হয়।

ওপেন বুক পরীক্ষায় কিছু সুবিধা রয়েছে যেমন-শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ভীতি এবং উৎকন্ঠা কমায়; পাঠ্য বই পড়ার ক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগী করে তোলে; সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একাধিক বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করে; পরীক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়; পরীক্ষায় নকল প্রবণতা কমে আসে এবং প্রশ্ন ফাঁস করার সুযোগ কম থাকে; লেখকের বইগুলো তুলনা করে পড়ার সুযোগ পায় ও সমালোচনা করতে পারে; উদ্ভাবনী ধারণা জন্মায়; কাগজ কম খরচ হয়; সময় কম ব্যয় হয়; টাকা কম খরচ হয়; পরীক্ষার ফলাফলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়; শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার করার ক্ষমতা বাড়ে; অপ্রয়োজনীয় পড়া বাদ দিয়ে যথাযথ তথ্য বের করার ক্ষমতা বাড়ায়; শিক্ষার্থীর সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতা ও ক্রিটিক্যাল থিকিং স্কিল বৃদ্ধি করে; উচ্চতর দক্ষতাকে আয়ত্ব করতে সহায়তা করে; শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের কতটা গভীরে গিয়ে অধ্যয়ন করেছে তা যাচাই করা যায়; এটি একটি আনন্দঘন কাজ, প্রতিযোগিতা বাড়ে, প্রয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়; পাশে কেউ থাকলেও সরাসরি শিক্ষার্থীকে সাহায্য করতে পারেন না, পারলেও আলোচনা করতে হয় যার মধ্যে যুক্তিতর্ক থাকে যা প্রায়োগিক দক্ষতা বাড়ায়; শ্রেণিকক্ষে তৈরি নোট, নিজের নোট, শিক্ষকের সামনে নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। 

ওপেন বুক পরীক্ষার কিছু অসুবিধা রয়েছে যেমন-শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়; বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই সঠিকভাবে বুঝতে পারে না এমন সকল বিষয় মুখস্ত করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়; শিক্ষকরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের তদারকি করতে পারেন না; অনেকক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ড্রপআউট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। 

ওপেন বুক পরীক্ষা দুটি উপায়ে পরিচালিত হয়। প্রথমত পরীক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসতে বলা হয়। সেখানে তাদের কাগজপত্র দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্য বই এবং অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করতে পারে যা পরীক্ষা দেয়ার সময় সমস্যা সমাধানে সহায়ক। বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে সেটির ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষার্থীকে একাধিক কাজ দেয়া যেতে পারে, আলোচনার পরবর্তী স্তর কি হতে পারে ইত্যাদিও সন্নিবেশিত হতে পারে এই ধরনের পরীক্ষায়। তবে, শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন হতে হবে ভিন্ন ভিন্ন। এক এক শিক্ষার্থীর এক এক ধরনের প্রশ্ন। ফলে নকল করা, অন্য ধরনের উপায় অবলম্বন করা কিংবা কাউকে জিজ্ঞেস করে উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকবেন। অর্থাৎ সেই সুযোগই রাখা হবে না। 

দ্বিতীয় পদ্ধতিটি ইউরোপের কয়েকটি দেশে বেশ জনপ্রিয়। সেখানে নির্দিষ্ট সময়ে প্রশ্নের একটি সেট পরীক্ষার্থীকে প্রেরণ করা হয়। পরীক্ষার্থীরা ইনস্টিটিউটের বিশেষ পোর্টালে গিয়ে বিশেষ লগইনের মাধ্যমে পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার সময়, তারা পাঠ্য বই, গাইড, নোট এবং অন্যান্য সহায়ক উপাদান ব্যবহার করতে পারেন। শিক্ষার্থীরা সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় পোর্টাল থেকে লগ আউট করে। এইভাবে, শিক্ষার্থীদের অনুলিপি যথাসময়ে ইনস্টিটিউটে পৌঁছায় এবং নির্দিষ্ট সময়ে ফলাফল ঘোষিত হয়।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ‘ওপেন বুক এক্সাম’ বা বাড়ি থেকে পরীক্ষা দেয়ার পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু এদেশে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষায় একই চালচিত্র। 

উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিয়ম পরিবর্তন করে প্রশ্নপত্র প্রণয়নে আধুনিকায়ন আনা যায়। উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় শিক্ষকেরা। ফলাফলের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার স্বার্থে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের খাতা দেখা বা বহির্মূল্যায়নের সুযোগ থাকছে না। তবে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষার্থীকে ভিন্ন সেট প্রশ্ন প্রেরণ করলে অনেকটা স্বচ্ছতা রক্ষা করা যাবে। 

ক্লাসে যতোটুকু পড়ানো হয়েছে তার ওপরই পরীক্ষা নেয়া হবে, অর্থাৎ যে বিষয়ে যতোটুকু সিলেবাস শেষ হয়েছে সেখান থেকেই করা হবে প্রশ্ন। ইউজিসি’র সাম্প্রতিক গাইডলাইন অনুযায়ী, দেশের সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা নিতেই হবে। সর্বত্র অনলাইনেই পরীক্ষা নেয়া হবে। থাকবে হোম অ্যাসেসমেন্ট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমেও চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে পারেন। কৌশলগত কারণে প্রতিটি কোর্সকে একাধিক ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন ধরন/পদ্ধতিতে পরীক্ষা যেমন: বর্ণনামূলক প্রশ্নগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে, এমসিকিউ পদ্ধতির পরীক্ষা, অনলাইনে কুইজ আয়োজন করা এবং অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েও গ্রেড দেয়া যাবে। বিষয়গুলো নিজ নিজ বিভাগের শিক্ষকেরা ঠিক করবেন। পরীক্ষার সময় ও পূর্ণমান কমানো যাবে, তবে মূল্যায়নকৃত ফলাফলকে প্রচলিত পূর্ণমানে রূপান্তর করে চূড়ান্ত ফলাফল তৈরি করতে হবে। যে বিষয়ে যতো ক্রেডিট আছে সেগুলো সেভাবেই থাকবে। শিক্ষার্থীরা যে কলেজে পড়েন সেই কলেজের শিক্ষকেরা মূল্যায়ন করবেন। 

ওপেন বুক এক্সাম চালু হলে পরীক্ষার্থীরা তথ্য, উপাত্ত মুখস্থ করার বাইরে একটি বিষয় কতোটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন সেটি যাচাই করাই এই পরীক্ষা পদ্ধতির মূল লক্ষ্য। এই সংস্কার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। তবে এটা বাস্তবায়নকালে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে বলেও তাদের মত। তারা মনে করেন, বিচ্ছিন্নভাবে শুধু পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করা ঠিক হবে না। পাঠদান পদ্ধতির পরিবর্তনের সঙ্গেই এটা করতে হবে। এই দুটো যুগপৎভাবে না হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হবে না। শিক্ষকদের প্রশ্ন করার ধরন আয়ত্ত করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র বইথেকে তথ্য নিয়ে উত্তর দেয়া বা শূন্যস্থান পুরণ করার সুযোগ না পান। 

আমাদের দেশে মাঝে মাঝে অনেক শিক্ষার্থী এমনিক কিছু অভিভবাকও ফাঁস হওয়া প্রশ্নের পেছনে অনেক সময় নষ্ট করেন কিংবা প্রশ্নফাঁসের গুজবে কান দিয়ে অসদুপায় অবলম্বন করেন। এগুলো থেকে মুক্তি পেতে পারেন যদি ‘ওপেন বুক পদ্ধতিতে’ পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। এই ধরনের পরীক্ষার কিছু ত্রুটিও রয়েছে। যেমন- কিছু কিছু শিক্ষার্থী কোনো তথ্য জানার চেষ্টা না করে, নিজে চিন্তা না করে পাঠ্যবইয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। গভীরভাবে কোনো কিছু ভেবে দেখেন না, ভেতরে ঢোকেন না। মনে করে থাকে পরীক্ষায় যা আসবে তা পরীক্ষার সময় বই কিংবা নোট দেখে বের করে পরীক্ষা দেবেন। সব পদ্ধতিরই ভালো খারাপ দুটো দিকই থাকে। তবে, ওপেন বুক পরীক্ষা পদ্ধতিতে ভালোর দিকটাই বেশি মনে হচ্ছে। 

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম, ঢাকা 

শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030910968780518