শাস্ত্রীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল খ্যাতিমান শিল্পী ওস্তাদ প্রকাশ কান্তি বড়ুয়া। দুই বাংলাজুড়ে যার রয়েছে অজস্র ভক্ত, শিক্ষার্থী। যিনি শাস্ত্রীয় সংগীত সাধনার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। গেয়েছেন রবীন্দ্র, নজরুল, গজল, ভজন ও আধুনিক ঘরানার গান। শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারাকে অক্ষুন্ন রাখতে অবিরাম ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশ বেতার-টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচলক ওস্তাদ প্রকাশ কান্তি বড়ুয়া’র শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য এবং জীবনের পড়ন্ত সময় পর্যন্ত অতিবাহিত করেছেন একটি ঐতিহাসিক গ্রামে। যে গ্রামটি ছিলো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিচরণভূমি। চট্টগ্রাম জেলাধীন পটিয়া উপজেলার অনতিদূরে সেই ইতিহাস বিখ্যাত গ্রামটিই হলো ‘গৈড়লা’। এর পাশের আরেকটি প্রসিদ্ধ গ্রাম হচ্ছে ‘তেকোটা’। এই দুই গ্রাম হচ্ছে লাগোয়া, পাশাপাশি। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে থেকে গ্রাম দুটি জুড়ে ছিলো অধিক সংখ্যক হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের বসতি।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে এই দুটি গ্রামের গৌরব খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বাঙ্গনে। তার একটি কারণও আছে। যেখানে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাষ্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, ব্রজেন সেন, মনি দত্তের মতো স্বাধীনতার বীর সংগ্রামীরা আন্দোলন পরিচালনার সুবিধার্থে নিরাপদ নির্ভরযোগ্য গ্রাম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সেই পশ্চিম তেকোটাই হলো ওস্তাদ প্রকাশ কান্তি বড়ুয়া’র ছায়া সুশীতল স্মৃতিমধুর গ্রাম। যেখানে তিনি শিল্প সংস্কৃতিকে জীবনের সঙ্গে গেঁথে সুশিক্ষার অন্তরালে দুঃখ সুখের ভেলায় নিজেকে তিলে তিলে তৈরি করেছেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনার আলোকে। আজ তিনি সফল জীবনজয়ী প্রাণপুরুষ। ওস্তাদ প্রকাশ কান্তি বড়ুয়া এ পর্যায়ে এসে খ্যাতিমান মানুষ হিসেবে নিজের আয়নায় নিজেই গর্বিত, উচ্ছসিত।শাস্ত্রীয় সংগীতের অনন্য সাধক শিল্পীর শৈশবের দুরন্ত ছেলেবেলাটি ছিলো প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে। ফুল পাখি লতাপাতা বিলে ঝিলে শস্য সবুজের প্রান্তরে মিতালি করে জীবনকে উপভোগ্য করেছেন। ছিলেন একজন দুর্দান্ত ফুটবল খেলোয়ার, হরদম মাথায় ঘুরতো ফুটবলের নানা কৌশল। খেলেছেন স্কুল-কলেজ জোনেও। অর্জন করেছেন বহু মেডেল, পুরস্কার। একসময় সেই ফুটবলার যুক্ত হন সংগীত সাধনায়; হয়ে উঠলেন দেশখ্যাত একজন স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদ। ফুটবল নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন জেলা-উপজেলায়। পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়নে যেখানে জীবন চলা দায় সেখানে সঙ্গীত সাধনায় নিজেকে জয় করতে পারবেন কখনো ভাবেননি। শত বাধা অতিক্রম করে অসাধ্যকে সাধন করতে দ্বারস্ত হয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাগুরুর। তাদের পরম আশির্বাদে শেষ পর্যন্ত জীবনে বেঁচে থাকার প্রাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন সংগীতচর্চাকে।
মাতা পারুল বড়ুয়া’র গর্ভে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মা-বাবার কোল আলোকিত করে ভূমিষ্ট হন শিশু প্রকাশ। বর্নাঢ্য জীবন পরিক্রমায় তিনি নিজেকে এতবেশি ঝলমলে উজ্জ্বল্যে আলোকিত করেছেন, প্রকাশ নামটি আজ সার্থকে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন মুকুটনাইট হাজী আনছুর আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন হাবিলাসদ্বীপ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। একই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করেন। পরে পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ঐতিহ্যবাহী হুলাইন ছালেহ নুর ডিগ্রী কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
এসএসসি পাস করার পর সংগীতের সুরের বাঁধনে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেন। বাড়িতে হারমোনিয়াম ছিলো না। বাধ্য হয়ে ছুটে যেতেন পার্শবর্তী প্রতিবেশি স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী ব্রজেন সেনের বাড়িতে। ব্রজেন সেনের একমাত্র সন্তান বিপ্লব সেন ছিলেন তার ফুটবল খেলার সাথি। সে সূত্র ধরে ঐ বাড়িতে ছিলো তার অবাধ যাতায়ত। তাদের দোতলা বাড়িটি ছিলা তার সংগীত চর্চার প্রথম জীবনের সাধন কেন্দ্র। বিপ্লবী ব্রজেন সেন ও তার স্ত্রী তাকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। জীবনের স্বপ্ন সফলতায় এই বিপ্লবী পরিবারের প্রতি শিল্পীর কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। এসএসসি শেষ করে সংগীত সাধনার দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়েন। তালিম নিতে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি ভর্তি হন চট্টগ্রাম শহরের আর্য্য সংগীত বিদ্যাপীঠে। সেখানে ওস্তাদ মিহির লালার সংস্পর্শে থেকে দীর্ঘ ৫ বছর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তালিম নিতে ছুটে যান ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়ার কাছে। তার কাছে একটানা ১৮ বছর প্রশিক্ষণ নেন এবং ওস্তাদজীর মৃত্যুর পুর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তার সংস্পর্শে থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের নানা বিষয় আয়ত্ব করেন। বিশেষ করে দ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরী, তাড়ানা, টপ্পা, রাগপ্রধানের উপর ব্যুৎপত্তি জ্ঞান অর্জন করেন। তালিম নেন ওস্তাদ মনোরঞ্জন বড়ুয়া ও ওস্তাদ অনুপ বড়ুয়ার কাছে। বেশ কয়েক বছর অনুপ বড়ুয়ার কাছে তালিম নেয়ার পর তার পরামর্শে বম্বের কিরানা ঘরনার খ্যাতিমান শিল্পী ভারতের প্রখ্যাত ওস্তাদ মশকুর আলী খাঁ এর নিকট ঢাকার বেঙ্গল ফাউণ্ডেশনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
সংগীত সাধনার পাশাপাশি অন্তত ৬০টিরও অধিক সামাজিক নাটকে অভিনয় করে বোদ্ধামহলে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। অবশ্য এখন নাটক থেকে বিরত থেকেছেন। যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও। প্রতিষ্ঠা করেন ‘পারুল সংগীত একাডেমী’ ও ‘সুরমৈত্রী ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ’ নামের দুটি সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দুটিতে শিল্পী নিজে নিয়মিত অসংখ্য শিক্ষার্থিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তার অনেক ছাত্র-ছাত্রী ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত হয়ে শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। সেই সঙ্গে তিনিও বেতার টেলিভিশনে গান গাওয়ার পাশাপাশি একজন লব্দপ্রতিষ্ঠিত সুরকার হিসেবে সংগীত পরিচালনায় নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। চট্টগ্রাম উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী কল্যাণ পরিষদ ও বুদ্ধ কীর্তন সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রচার পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সহসভাপতি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন বৌদ্ধ শিল্পী সংস্থা।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিষয়ে যাদের নৈপুণ্য পরিবেশনা শিল্পীকে আন্দোলিত করতো সেই সব তালিকার মধ্যে আছেন ওস্তাদ বড় গোলাম আলী খাঁ, ওস্তাদ রশীদ খাঁ, ওস্তাদ মশখুর আলী খাঁ, ওস্তাদ আমীর খাঁ, ওস্তাদ অজয় চক্রবর্তী প্রমুখ গুরুজন। যাদের গানে এখনো হৃদয় টানে তাদের মধ্যে আছেন- গজল শিল্পী মেহেদী হাসান, গোলামআলী খান, জাগজিৎ সিং, লতা মঙ্গেশকর প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পী বৃন্দ।
স্ত্রী, দুই ছেলে, এক পুত্রবধু নিয়ে সাজানো গোছানো শিল্পীর নান্দনিক শৈল্পিক ভুবন। সহধর্মীনি শেলী বড়ুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র স্কুল শিক্ষিকা। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ-শেলীর দাম্পত্য জীবনের শুভ সূচনা। শিল্পী-শিক্ষক দম্পতির কোলজুড়ে আসে দুই পুত্র সন্তান। জ্যেষ্ঠ সন্তান শিল্পী প্রত্যয় বড়ুয়া অভি। শাস্ত্রীয় সংগীতের তরুণ প্রজন্মের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাধারণ শিক্ষায় প্রত্যয় বড়ুয়া ইঞ্জিনিয়ারিং- এ বিএসসি এবং এমএসসি ডিগ্রিধারী। প্রত্যয় সংগীত সাধনায় বেশ বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। পিতার হাতধরে তিনিও শাস্ত্রীয় সংগীতের একজন সফল শিল্পী হিসেবে ইতিমধ্যে দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। পুরো বাংলাদেশ জুড়ে সংগীতবোদ্ধা মননে তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ভারতীয় বিখ্যাত আধুনিক (কিংবদন্তী শিল্পী হেমন্ত, মান্না দে, সতীনাথ, কিশোর কুমার প্রমুখ) তার কণ্ঠে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত প্রত্যয় বড়ুয়া মঞ্চের একজন জনপ্রিয় সংগীত তারকা হিসেবে নিজেকে আবির্ভূত করতে সক্ষম হয়েছেন। ছোট সন্তান পিয়াস বড়ুয়া চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসের একজন মেধাবী শিক্ষার্থি।
শিল্পী প্রকাশ কান্তি বড়ুয়া ও শিল্পী প্রত্যয় বড়ুয়া অভি সম্পর্কে তারা দু’জন বাবা-ছেলে। দ্বৈতকন্ঠে গাওয়া তাদের একটি অসাধারণ গান এখন হরদম শোনাযায়; যেটি ইউটিউব চ্যানেলে ‘বাবা ছেলের টান’ শিরোনামে সার্চ দিলে শোনা যাবে। গানটির যেমন কথা তেমনি সুর। গানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর প্রচারিত হয়েছিলো। গানটি শুনলে যে কেউ মুহূর্তে অন্যজগতে হারিয়ে যাবেন। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম গানের তালিকার মধ্যে এই গানটি স্থান করে নিয়েছে। হলফ করে বলতে পারি বাবা-ছেলের করা গানটি শোনার পর হৃদয়ে কম্পন ধরবে, সেই সঙ্গে চোখ দিয়ে বাধাহীনভাবে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। আমি এবং আমার পরিচিতজন যতবারই গানটি শুনেছে তাদের অনুভূতি ছিলো ঠিক একই রকম। প্রকাশ বড়ুয়া এ প্রসংগে বলেন, গানটি প্রথমদিকে তোলার সময় আমরা বাবা-ছেলে বহুবার কেঁদেছি। বিটিভি কেন্দ্রে গানটি ভিডিও ধারনের সময় যারা ছিলেন তারা কেঁদেছে সাথে আমরাও। শিল্পী ও কলাকুশলীবৃন্দ এতবেশি আবেগপ্রবণ হয়েছিলো যে, এসময় একাধিকবার ভিডিও ধারণ বন্ধ করে দিয়ে ড্রেসিং রুমে ফিরে যেতে হয়েছে। সে এক অসাধারণ মুহূর্ত আমরা বাবা-ছেলে অতিক্রম করেছি। আর গানটি যখন প্রচার হয় সেই থেকে ভালোলাগার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে অনেকে কেঁদে ফেলেছে। এই জন্য শ্রোতাদের আগ্রহের কারণে আমরা গানটি ইউটিব চ্যানেলে আপলোড করি। গানের কথা “হয়নি বলা ভালোবাসি কতো, হয়নি জানা তোমার বুকে কী ক্ষত”। গানের মূল শিল্পীদ্বয় হলেন দেশের বরেণ্য সংগতি শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী ও কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর। গানের কথা লিখেছেন- গীতিকার সুহৃদ সুফিয়ান আর সুর দিয়েছেন কন্ঠ শিল্পী কিশোর দাশ।
ওস্তাদ প্রকাশ বড়ুয়া বলেন, শাস্ত্রীয় সংগীত হচ্ছে শুদ্ধ সংগীতের মূল শ্রোতধারা; যেটি ব্যতীত কেউ কখনো উচ্চমানের শিল্পী হতে পারবে না। আজকাল গান একটু করতে পারলেই অনেকে শিল্পী বনে যান ; কিন্তু প্রকৃত অর্থে শিল্পী বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু নয়। শিল্পী হতে গেলে নিয়মিত রেওয়াজ বা চর্চার মধ্যে ডুবে থাকতে হবে। শিক্ষার যেমন শেষ নেই, সংগীত সাধনারও শেষ নেই। যে যত বেশি রেওয়াজ বা কন্ঠ অনুশীলন করে সে ততবেশি নিজেকে পাকাপোক্তভাবে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। সংগীত সাধনা হচ্ছে সাগর-মহাসাগর সমতুল্য। সংগীত চর্চায় শেষ বলতে কিছু নেই।
লেখক: সাংবাদিক