কারিগরি ও স্বাস্থ্য শিক্ষায় অধিক সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজন - দৈনিকশিক্ষা

কারিগরি ও স্বাস্থ্য শিক্ষায় অধিক সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজন

অধ্যাপক এ এন রাশেদা |

দীর্ঘকাল শিক্ষকতা ও শিক্ষাবিষয়ক নানা সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াসে ‘শিক্ষাবার্তা’ নামে একটি মানসম্মত পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছেন অধ্যাপক এ এন রাশেদা। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে কারিগরি ও স্বাস্থ্য শিক্ষায় প্রয়োজনীয় শিক্ষাকাঠামোর অভাব নিয়ে নিজের মতামত জানিয়ে বেশকয়েকটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছিলেন। আজ পুন:প্রকাশিত হলো।  

এইচএসসি উত্তীর্ণ অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীই স্বপ্ন দেখে কারিগরি শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে সফল ভবিষ্যত গড়ার। কিন্তু উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা কম হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই সেই আশা পূরণ হয় না। এ-কারণে অনেকে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সংশয়ে থাকে। অনেকেই চায় বোর্ড পরীক্ষায় ভালো ফল করে দেশের প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে। কিন্তু প্রতিবারের মতোই বোর্ড পরীক্ষায় ভালো ফল করে প্রায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়তে পারে না তাদের আশানুরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ১০ টি শিক্ষা বোর্ডে মোট উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩৬৯ জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাই ২৮ হাজার ৬৭১ জন। এছাড়া রয়েছে জিপিএ-৪ থেকে ৫ পাওয়া লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। কিন্তু সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসন নেই কারিগরি বা চিকিৎসা শিক্ষায়। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। কিন্তু আসন নিদিষ্ট। মেডিকেল ছাড়া একজন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর প্রথম ইচ্ছাই থাকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।

দেশের পাঁচটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটিতে এইচএসসি উত্তীর্ণরা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সুযোগ পায়। তবে চারটির মধ্যে শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ বুয়েট। এছাড়া রয়েছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় [চুয়েট], খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় [কুয়েট] অন্যতম। তবে সর্বত্রই আসন স্বাভাবিক কারণেই নির্দিষ্ট। চারটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে আসনসংখ্যা রয়েছে ২ হাজার ৫১১টি। এছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসন সংখ্যা রয়েছে তিন হাজার ৩৫০টি। অন্যদিকে দেশের মোট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আসন সংখ্যা এক হাজার ৬৪৭টি। তাই আসনসংখ্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এ-প্রসঙ্গে বিসিআইসি কলেজের জনৈকার মত, ‘এ-বার ফল ভালো হলেও যথেষ্ট আসনসংখ্যা না থাকায় পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবো কি-না জানি না । ‘যা-আসন সংখ্যা আছে তার মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষক এবং অন্যান্য কোটায় অন্তর্ভুক্ত। ফলে এই স্বল্প-আসনও বিভিন্নভাবে ভাগাভাগি হয়ে যায় । আমাদের সুযোগ পাওয়া অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে।’ যদিও এ-নিয়ম সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযোজ্য নয়। নটর ডেম কলেজ থেকে এ-বার জিপিএ-৫ পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর বক্তব্য, ‘আসন সংখ্যা কম হওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না।’

তার মতে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার প্রতি ২০-৩০ হাজার টাকা ফি দিয়ে পড়াশোনা তাহলে কি নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মেধাবী শিক্ষার্থীর করা সবার পক্ষে সম্ভবপর নয়। পড়াশোনার সুযোগ পাবে না? ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রীর অভিমত ‘সর্বোচ্চ ‘গ্রেড পেয়েও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ভর্তি নিয়ে অনেক টেনশনে আছি। বুয়েট বা মেডিকেলে ভর্তি হতে না পারলে এত ভালো রেজাল্ট দিয়ে কী করব? অনেক আগে থেকেই ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রস্তুতিও ভালো। কিন্তু এত অল্প সিটে ভর্তির সুযোগ পাব কি-না ।' ভর্তি প্রসঙ্গে হলিক্রস কলেজের এক ছাত্রী মেডিকেলে ভর্তির ব্যাপারে বলেছে, ‘সরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ না পেলে হয়তো প্রাইভেট কোনো মেডিকেলে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াশোনার খরচ যেমন বেশি, তেমনি পড়াশোনার মানও সরকারি মেডিকেলের মতো নয়’।

দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মেডিকেল কলেজ ১৭টি, ডেন্টাল কলেজ ৩টি, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ৫টি, টেক্সটাইল কলেজ ৬টি ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৪ টি এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠেছে ৪৩টি, ডেন্টাল কলেজ ১১টি, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ১টি তবে কয়েকটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং শাখা রয়েছে (২০১০)। আপাতত মনে হতে পারে ৪৩ টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নিশ্চয়ই ভর্তি সংকট মোচনে অনেক অবদান রাখছে। কিন্তু যাদের বেসরকারি বলা হচ্ছে আসলে এগুলো বেসরকারি নয়, এ- গুলো প্রাইভেট। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলে এগুলো মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হতো না, হতো জনকল্যাণে; প্রতিষ্ঠানের আয় প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে ব্যবহৃত হতো। যেমন এক সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রজমোহন কলেজ, ব্রজলাল কলেজ, আনন্দমোহন কলেজ, কারমাইকেল কলেজ, মুরারিচাঁদ কলেজ প্রভৃতি সাধারণ শিক্ষাধারার কলেজ। এভাবেই আজকের বুয়েট-এর গোড়াপত্তন হয়েছিলো ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সার্ভে স্কুল হিসেবে। জমি দান করেছিলেন তৎকালীন নবাব পরিবার। পরবর্তীতে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর পিতা নবাব আহসানউল্লাহর নামে সরকারি সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। প্রতিষ্ঠাতারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজেদের আয়ের উৎস হিসেবে দেখেননি। কিন্তু বর্তমানে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া ব্যাক্তি মালিকানায় যে-সব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যে-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছেন তা শুধু মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে। তারা ক্ষেত্র দেখে এখানে অর্থ-লগ্নি করেছেন মাত্র। আত্মীয় স্বজনকে নানা পদে বসিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা বেতন হিসেবে নিয়ে নিচ্ছেন। তাই শিক্ষক সংকট বা স্বল্পতা এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। শিক্ষক নিয়োগ তেমন করা হয় না, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ভাড়ায় শিক্ষক নিয়ে আসা হয়। তাই সার্বক্ষণিক নয়। আর দু-জায়গায় পড়াতে যেয়ে কোথাও ক্লাস পরিচালনায় প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব, কোথাও শিক্ষকের বসার জায়গার অভাব এবং শিক্ষকের সময়ের অভাব, সঠিক প্রস্তুতির অভাব, এই সবকিছু মিলে শিক্ষাদান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় নিম্নমানের। শিক্ষার্থীরা হয় বঞ্চিত। কাজেই অর্থ ব্যয় করেও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ পায়না। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই লাইব্রেরি, খেলাধুলা বা মাঠের অভাব আছে। 

এমনিতেই দেশে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা ও মেধানুযায়ী যদি তাদের পরবর্তী ধাপের শিক্ষায় শিক্ষিত করা না যায় তবে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবলের ঘাটতি দেখা দেবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে কারিগরি শিক্ষায় প্রচুর জনবল দরকার আর মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতেও প্রয়োজন অনেক ডাক্তার ও অনেক স্বাস্থ্যকর্মী। এসএসসি পাসের পর যেমন নার্সিং পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে, নাসিং পেশার আরো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, এ-পেশায় আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং সুযোগ সুবিধাও সৃষ্টি করতে হবে; তেমনি সেখানে শিক্ষকের যোগানও থাকতে হবে। সব কিছু মিলিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কারিগরি, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষিত, সৃষ্টিশীল, চিন্তাশীল ও দক্ষ মানুষ গড়ে তোলার বিকল্প যে নেই – তা শিক্ষামন্ত্রণালয়কে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক এ এন রাশেদা

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030739307403564