প্রথমে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশ নিরক্ষরমুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে পরে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছিলেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ। দুটো ঘোষণাই ছিলো বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত সুখবর! কিন্তু তা অর্জিত হয়নি আজো! অথচ আমাদের সবাইকে ন্যূনতম অক্ষর জ্ঞান দান করে, নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে সমগ্র জাতিকে মুক্ত করার নামে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পেছনে এ যাবত ব্যয় হয়েছে সরকারি, বেসরকারি ও দাতা সংস্থাগুলোর বিপুল অর্থ, শ্রম এবং সময়। আজো আমরা মুক্ত নই সেই অভিশাপ থেকে।
অনেকের মতে এসব সরকারি, বেসরকারি ও দাতা সংস্থার পদক্ষেপের এবং অর্থ ব্যয়ের কারণেই বৃদ্ধি পেয়েছে সাক্ষরতার হার। যদিও সাক্ষরতার সংজ্ঞা অনুসারে এদের মধ্যে কতজন প্রকৃতপক্ষে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ করতে পারেন তা প্রশ্নবোধক! বাস্তবতা হচ্ছে, একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় – ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশে সাক্ষরতার হার ছিলো ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৯ এ ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০২০ এ ছিলো ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দেও সাক্ষরতার হার একই বলে জানানো হয়েছে। আর সর্বশেষ ২০২২ এ দেশে সাক্ষরতার হার ছিলো ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ।’ অর্থাৎ গত ৫ বছরে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২.৯ শতাংশ। সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয়ের তুলনায় এই অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। এতে আগামী ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করার সরকারি লক্ষ্য অর্জিত হবার সম্ভাবনা নেই! এই গতিতে এগিয়ে গেলে সাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করার জন্য কম/বেশি ২৫ বছর লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ব্যয় হবে আরো অনেক অর্থ।
বাস্তবে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে শিশুদের স্কুলে ভর্তির হার বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়ার হার হ্রাস পেলেও শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে বয়স্কদের অনাগ্রহ বা অলসতাই অশিক্ষার অন্যতম কারণ। অসচেতনতা ও অসচ্ছলতা তো আছেই। তদুপরি নেই কোনো বাধ্য বাধকতা। ন্যূনতম লেখাপড়া না জানার দায়ে বড় কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে মনে করছেন না নিরক্ষররা। কেননা, তারা ব্যক্তিগত জৈবিক ও বৈষয়িক সমস্যাকেই বড় করে দেখেন অশিক্ষার অন্ধকার চোখে। তাই তাদের প্রত্যেককে কোনো না কোনোভাবে বাধ্য করতে হবে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করতে। বুঝিয়ে দিতে হবে, শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া অচল হয়ে যাবে তার জীবনযাপন। কেননা, কাউকে কোনো কিছু শিক্ষা দেয়া যায় না, যদি সে শিক্ষা গ্রহণের তাগিদ অনুভব না করে। একটি সরকারি পদক্ষেপই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ: শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ ১৯৮১-৮২ খ্রিষ্টাব্দের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ ৫০ নম্বর পুরস্কার দিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞান দেয়ার জন্য। পরীক্ষার্থীরা প্রথমে মনের আনন্দে এবং পরে বাধ্য হয়ে বারবার গিয়েছে নিরক্ষরদের বাড়ি বাড়ি। তখন আমি নিজেই শুনেছি নিরক্ষর ব্যক্তির মন্তব্য - ‘আমি লেখাপড়া শিখলে তুমি নম্বর পাইবা আমি কী পামু?’ এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন কিশোর পরীক্ষার্থীরা। তবে পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার তাগিদে কেউ কেউ দস্তখত শিখিয়েছে দু'এক জনকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামান্য লেখাপড়া জানে এমন লোকদের হাজির করেছে স্যারদের সামনে। মিথ্যে করে বলেছে- উনাকে আমি লেখাপড়া শিখিয়েছি। নম্বর পেয়ে গেছে পরীক্ষায়। আসলে যে নিরক্ষর সে পায়নি বা নেয়নি অক্ষর জ্ঞান। চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে অত্যন্ত মিতব্যয়ী একটি পদক্ষেপ।
এছাড়াও সম্ভব হয়নি দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচি ও নিজেদের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন’ প্রকল্পের প্রকৃত সফলতা অর্জন। সেখানেও ছিলো নিরক্ষরদের আগ্রহ তৈরির ব্যর্থতা। শিক্ষা লাভের জন্য বয়স্কদের আমরা নিতে পারিনি সেই নাইট স্কুল বা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে। সব শিশুকে নিতে পারিনি বা ধরে রাখতে পারিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমরা হয়তো মনে রাখিনি যে, শিখন একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের আন্তরিকতার ওপরই নির্ভর করে এর সফলতা।
আলোচিত বাস্তবতার আলোকে দেখা যায় সার্বিক সাক্ষরতা অর্জন দ্রুত ও নিশ্চিত করতে চাইলে অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি নিম্নরূপ দুয়েকটি আইন বা আদেশ জারি করা জরুরি। যেমন: বিয়ের বর/কনে/সাক্ষী হতে হলে; যে কোনো দলিলের দাতা/গ্রহীতা/সাক্ষী হতে হলে; কোনো মামলার বাদী/বিবাদী/সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দী দিতে গেলে; ব্যাংক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে গেলে; যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে ও ভোট দিতে চাইলে; যে কোনো প্রতিষ্ঠানে যে কোনো পদে চাকরি প্রার্থী হলে; নিজের বা অন্যের পেনশনের বা ভাতার টাকা পেতে হলে; কোনোরূপ সরকারি সাহায্য গ্রহণ করতে চাইলে; বিদেশ যেতে চাইলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের এমন শিক্ষা থাকতে হবে যাতে তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অন্তত বাংলা ভাষায় পড়ে ও বুঝে টিপসহির পাশাপাশি নিজের ‘নাম স্বাক্ষর’ দিতে পারেন। আমি আগেও জাতীয় পত্রিকায় এবং অন্যান্য মিডিয়ায় উত্থাপন করেছি এই প্রস্তাব। শুনতে ও মানতে একটু কঠিন মনে হলেও সত্যিকারার্থে ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করে সরকারের লক্ষ্য অর্জন করতে চাইলে এখনই জারি করতে হবে উল্লিখিত আদেশ; যা কার্যকর করতে হবে ২০৩১ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে। তবে শিশু, প্রতিবন্ধী ও অতি বৃদ্ধদের মানবিক কারণেই রাখতে হবে এই আদেশের বাইরে।
যারা স্বার্থহীন আন্তরিকতা দিয়ে চাচ্ছেন, সাক্ষরতার হার দ্রুত শতভাগে উন্নীত হোক, দেশ দ্রুত নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক, তারা আমার এই প্রস্তাব সমর্থন করবেন আশা করি। বাস্তবতা হচ্ছে, আইনের/আদেশের বাধ্যবাধকতা দ্বারা নিরক্ষরদের শেখার আগ্রহ নিশ্চিত করা যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, আমরা উপদেশের চেয়ে কড়া নির্দেশই মান্য করি বেশি। তবে আমার বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, শুধু আইন করে বা আদেশ করে দিলেই নিরক্ষরদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে। বরং সরকারি পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই হোক আর ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই হোক ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশপ্রেমিক ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, চাকুরে, গৃহিণী, ইমাম, সমাজকর্মী, খেলোয়াড়, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব শিক্ষিত ব্যক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে উদার মন নিয়ে। একজনকে নিতে হবে কমপক্ষে একজনের দায়িত্ব। কাজের লোক বলে, দরিদ্র বলে, ভিক্ষুক বলে নিরক্ষরদের প্রতি কোনো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অবহেলা নয়; বরং শ্রদ্ধাভরে টেনে নিতে হবে কাছে। অত্যন্ত ধৈর্য ধরে দিতে হবে শিক্ষা। নতুন কারিকুলামের আওতায় শিক্ষার্থীদেরও যুক্ত করতে হবে এই মহৎ কাজে। আবারো প্রমাণ করতে হবে - ‘আমরাও পারি’। তবেই সম্পাদিত হবে পুণ্যকর্ম। তৈরি হবে সত্যিকার নিরক্ষরমুক্ত বাঙালি জাতি। বিশ্ব দরবারে বৃদ্ধি পাবে আমাদের প্রকৃত গৌরব।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।