ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের বক্তব্যের জবা দিতে দলীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, কুটনীতিকদের বিরুদ্ধে বলার মতো শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ সমীচীন হবে না। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক হতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকা বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চেয়ারম্যান এবং সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। তবে কো-চেয়ারম্যান পদে এখনও কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। দলীয় সভাপতি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনায় ১৪টি উপকমিটি গঠন বিষয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্য করায় চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চম্বল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ফজলুল হক চৌধুরীকে শোকজের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী নেতাদের কূটনীতিকদের বিষয়ে কোনো কথা না বলার নির্দেশনা দেন।
শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার এ বৈঠকে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় তপশিল ঘোষণার পর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নতুনভাবে ধার্য ৫০ হাজার টাকার দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা দেওয়ার কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমবারের মতো অনলাইনেও ফরম কেনা ও জমার সুযোগ রাখা হয়েছে।
বৈঠক শেষে গণভবনের গেটে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা সদস্য হিসেবে থাকবেন।
তিনি জানান, উপকমিটিগুলো এখনও গঠন হয়নি। গতবারের মতো এবারও ১৪টি উপকমিটি হবে। তবে উপকমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতায় পরিবর্তন আসবে। কেননা উপকমিটিতে থাকা কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন।
পিটার হাসের বিষয়ে শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্য করায় দলীয় এক নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার বিষয়টি অবহিত করে ওবায়দুল কাদের বলেন, এ ধরনের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজের জন্য সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নেত্রীও আমাদের সবাইকে সতর্ক করে দিতে বলেছেন।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নেতাকর্মীকে সর্বাত্মক নির্বাচনী প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না, এটা ঠিক নয়। সুতরাং, জোরেশারে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। ভোটারদের কাছে যেতে হবে। খালি মাঠে গোল দেওয়ার কথা চিন্তাতেও আনা যাবে না।
নির্বাচন ভন্ডুলের চক্রান্ত যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ করার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন ভন্ডুল করার যে চক্রান্ত এখন চলছে, তা প্রতিহত করতে হবে। এদের পরাজিত করতে হবে। বিএনপির নেতৃত্বে যতক্ষণ আগুন সন্ত্রাসসহ নাশকতা চলবে, ততক্ষণ নেতাকর্মীকে
সারাদেশে সতর্ক পাহারায় থাকতে হবে। সবাইকে আরও সক্রিয় হতে হবে। দলের আট বিভাগীয় কমিটির নেতাদের প্রতিটি বিভাগ ও জেলায় গিয়ে সতর্ক পাহারার বিষয়টি জোরদার করার পাশাপাশি তৃণমূলকে সুসংগঠিত করার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
বৈঠক সূত্র আরও জানায়, দলের দু'জন নেতা দলীয় এমপিদের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সিরাজুল মোস্তফা সম কক্সবাজারের একজন এমপির সমালোচনা করেন। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য গোলাম রাব্বানী চিনু এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এত উন্নয়ন করেছেন যে, তাঁকে ভোট না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কিছু কিছু এমপির কারণে অনেকেই বি দলকে ভোট দেবে না। কেননা এসব এমপি দলের নেতাকর্মীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করছেন।
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে এভাবে বলা যাবে না। কেননা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন তো আমি দেব। জনপ্রিয় ব্যক্তিদেরই মনোনয়ন দেওয়া হবে। আর যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, তাঁর পক্ষেই কাজ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য বিপুল ঘোষ ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের বিদ্যমান কমিটি ভেঙে বিএনপিসহ বিতর্কিত লোকদের দিয়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ রে তোলেন। তিনি বলেন, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী দে লীগে কোনো শৃঙ্খলা না থাকায় দলের মধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন সম্মেলন করে সন্ত্রাসী ও ক্রসফায়ারের আসামিদের কমিটিতে আনা হয়েছে। এমন এক ইউনিয়ন সভাপতি ফরিদপুর-৩ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী বিশিষ্ট শিল্পপতির তোরণ ভেঙেছেন, ব্যানার ছিড়েছেন। এসব কমিটি গঠনের পেছনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন। এমন দু'জন প্রভাবশালী শীর্ষ নেতাকেও দায়ী করেন বিপুল ঘোষ। এ ছাড়া দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য সফুরা বেগম লালমনিরহাটে দলের এক কর্মী হত্যার বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বিতর্কিত ভূমিকা পালনের অভিযোগ তোলেন।
এ সময় দলের চার বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, মির্জা আজম, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও সুজিত রায় নন্দী নিজ নিজ বিভাগের সাংগঠনিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এ সময় শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল অভিযোগ করেন, ময়মনসিংহে দলের বিভিন্ন কমিটি গঠন বিষয়ে স্থানীয় এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল বাড়াবাড়ি করছেন। বৈঠকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি তপশিল ঘোষণা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক দলীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, বিএনপি ভালো করেই জানে নির্বাচনে তাদের জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। জনগণ তাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়নি। তাই এ আন্দোলন কোনোদিন সফলতা পাবে না। আর এ দেশে আন্দোলন ব্যর্থ হলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। এটাই বাস্তবতা।