অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক মার্চ ২০২৪-এ জারিকৃত পেনশন-সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুতি সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তিকরণ ও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে বাংলাদেশের প্রায় ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এমপি এবং শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, এমপির সঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা, যা গতকাল বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই, ২০২৪) হওয়ার কথা থাকলেও সেটা বাতিল হয়েছে; কিন্তু যে কোনো সময় এ বৈঠক হতে পারে। আবার আমরা আশা করতে পারি, একটা অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যয় স্কিম নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল সেটার একটা সন্তোষজনক সমাধান হবে। তাই প্রত্যয় স্কিম নিয়ে আজ আর কোনো আলোচনা নয়। অপর দুটি দাবির একটি স্বতন্ত্র পে-স্কেল কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, তথা সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য জরুরি যে বিষয়ে একটা যৌক্তিকতা ও বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর চেষ্টা করব। কেননা আমরা মনে হয়, পেনশন নিয়ে যত টেনশন, এগুলো কিছুই আর থাকবে না, যদি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র পে-স্কেলের ব্যবস্থা করা হয়। এটা কোনো নতুন দাবি না। এটা অত্যন্ত বৈধ এবং ন্যায্য দাবি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে (দিন বদলের সনদ) অঙ্গীকার করেছিল, ক্ষমতায় গেলে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করার সুপারিশ করা হয়। ২০১৫ সালেও একটা মৌখিক আশ্বাস দেয়া হয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং পরবর্তীতে শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র পে-স্কেল দেয়া হবে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে আমরা দেখছি, সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং স্বতন্ত্র পে-স্কেল কোনটাই না দিয়ে, উল্টো পেনশনের সুযোগ-সুবিধা কেটে নেয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। শুক্রবার (১০ জুলাই) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরো জানা যায়, আমরা কমবেশি সবাই জানি, তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন যারা বিভিন্ন সেশনের এবং বিভিন্ন ব্যাচের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র, সেহেতু এসব মেধাধী শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি স্বতন্ত্র পে-স্কেল থাকা খুবই জরুরি। কেননা পে-স্কেলের মধ্যেই মাসিক বেতন ও বিভিন্ন ভাতাদির পাশাপাশি পেনশনের ব্যাপারটিও অর্থাৎ নির্দিষ্ট বয়সকাল পর্যন্ত চাকরিপর্ব সমাপ্ত করে শেষ বয়সে সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি যেহেতু বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে, সেহেতু স্বতন্ত্র পে-স্কেলের মাধ্যমে তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের মানবসম্পদের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে উৎসাহী এবং আগ্রহী করে তুলতে পারে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশেই তুলনামূলকভাবে শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদি অত্যন্ত কম। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ালেও বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ এবং বিস্তার অত্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী হলেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশ হিসেবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করলেও এবং দক্ষিণ এশিয়ার ‘ইমার্জিং ইকোনমিক টাইগার’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেলেও দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম। একটি তুলনামূলক চিত্র আমি এখানে পেশ করছি। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক যখন প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে তখন তার বেতন হচ্ছে ২২ হাজার টাকা। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় প্রভাষকের কোনো পদই নেই। যেখানে বাংলাদেশে একজন সহকারী অধ্যাপকের বেতন হচ্ছে ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, যেখানে ভারতে হচ্ছে ৫৫ হাজার টাকা ৫০০ টাকা, পাকিস্তানে হচ্ছে ১ লাখ ৪ হাজার টাকা এবং শ্রীলঙ্কায় হচ্ছে ১ লাখ ৫ হাজার ৬৮০ টাকা। যেখানে একজন সহযোগী অধ্যাপকের বাংলাদেশে বেতন হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা, সেখানে ভারতে হচ্ছে ৯০ হাজার টাকা, পাকিস্তানে হচ্ছে ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং শ্রীলঙ্কায় হচ্ছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাংলাদেশে একজন অধ্যাপকের বেতন শুরু হয় ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে, সেখানে ভারতে হচ্ছে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা এবং শ্রীলঙ্কায় ১ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪৫ টাকা। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় এই বেতনের পাশাপাশি অন্যান্য নানান সুযোগ-সুবিধা থাকলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সেই পরিমাণ কোনো সুযোগ-সুবিধা সে অর্থে নেই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যদি একটি স্বতন্ত্র পে-স্কেলের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে তোলা না যায়, তাহলে সমাজের মেধাবী ও অগ্রসর চিন্তার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসবে না। ফলে জাতি ক্রমান্বয়ে মেধাশূন্য হয়ে পড়বে।
এখানে মনে রাখা জরুরি, প্রতিটা পেশার নিজস্ব একটা চরিত্র আছে, নিজস্ব ধারণ আছে, দায়-দায়িত্বের নিজস্ব প্রকৃতি আছে এবং মেধা ও শ্রমের বিনিয়োগের বিভিন্ন পরিসর আছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে অন্য পেশার সঙ্গে তুলনা করে অন্য পেশাকে খাটো করার বা ছোট করার কোনো কারণ নেই। প্রতিটা পেশার সামাজিক গুরুত্ব আছে, অর্থনৈতিক তাৎপর্য আছে এবং প্রতিটি পেশার উল্লেখযোগ্য অবদান আছে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য। অন্য সব পেশার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে আমি বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশাটি শিক্ষা, গবেষণা, প্রকাশনা এবং জাতি নির্মাণের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেশা। আগামী দিনে যারা জাতিকে নেতৃত্ব দেবে; রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে এবং সমাজ ব্যবস্থায় যারা নেতৃত্বে দেবে সেই প্রজন্ম তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজের মেধা, মনন, গবেষণা, প্রকাশনা এবং নিষ্ঠা দিয়ে জ্ঞান সৃজন, জ্ঞান বিতরণ এবং জ্ঞান সংরক্ষণের একটি মেধাবী ও সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগামী দিনের জাতির নেতৃত্বকে তৈরি করে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজের ধরন, চিন্তার ধরন, পাঠন-পাঠনের ধরন এবং জ্ঞান বিতরণের কাজ অন্য পেশা থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কোনো অফিস টাইম নেই। সকাল ৯টা থেকে ৫টা অফিস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অফিসটাকে অফিসে রেখে আসেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা হচ্ছে ২৪/৭ পেশা, অর্থাৎ সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টার পেশা (রিটোরিক অর্থে!)। ঘুমের সময়টা বাদ দিয়ে পুরো সময়টাই একজন সত্যিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পড়াশোনা, চিন্তা-ভাবনা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, গবেষণা, লেখালেখি, গবেষণা তত্ত্বাবধান, ল্যাবরেটরিতে ট্রেইটিং, ক্লাস, পরীক্ষা, মূল্যায়ন এবং প্রকাশনার কাজে ব্যয় করেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে আজীবন পড়তে হয়। প্রতিনিয়ত পড়তে হয়। কারণ একজন শিক্ষককে নতুন নতুন পঠন-পাঠন নিয়ে, নতুন নতুন জ্ঞান নিয়ে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াতে হয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে নিয়মিতভাবে গবেষণা কাজে সম্পৃক্ত থাকতে হয়, নিজের স্কলারশিপ থেকে শিক্ষার্থীদের আলোকিত করতে হয় এবং লেখালেখির মাধ্যমে জ্ঞান সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়। তাই একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে শুধু একটা চাকরিজীবী বা সাধারণ পেশাজীবীর নিক্তিতে মেপে হিসাব করা যাবে না।
এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যাতে কোয়ালিটি শিক্ষা কার্যক্রমে, মৌলিক গবেষণা কাজে এবং উন্নতমানের প্রকাশনায় নিজেদের গভীরভাবে নিয়োজিত রাখতে পারেন, নিবিড়ভাবে মনোনিবেশ করতে পারেন এবং সক্রিয়ভাবে অবদান রাখতে পারেন, সেজন্য তার একটি আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা জরুরি। এসব কিছুর বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য এটি স্বতন্ত্র পে-স্কেলের ব্যবস্থা করা গেলে, এসব পেনশনজনিত নানান টেনশন থেকে যেমন মুক্তি পাওয়া যাবে, তেমনি শিক্ষা কার্যক্রমের গুণগতমান বৃদ্ধি করা যাবে, গবেষণার মান বৃদ্ধি করা যাবে এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনার পরিমাণ তখন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবস্থান করবে এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্বব্যাপী দেশের নাম উজ্জ্বল করতে সক্ষম হবে। সুতরাং শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সেটা কখনো বিফলে যায় না। বরঞ্চ, সেটা ‘মাল্টিপল আউটকম’ হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে উত্তরোত্তর উন্নতিতে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ও সক্রিয় অবদান রাখবে। তাই অন্য পেশার সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় না গিয়ে, কে বেশি বেতন পেল বা কে কম বেতন পেল, এ ধরনের প্রতিযোগিতায় না গিয়ে, আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এটি স্বতন্ত্র পে-স্কেলের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।
মনে রাখতে হবে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। তাই মেরুদণ্ডকে শক্ত করতে হলে, টেকসই ও মজবুত করতে হলে, শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে। এবং যারা এই শিক্ষাদাতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সব স্তরের শিক্ষকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। একটি স্বতন্ত্র পে-স্কেল থাকলে জাতির মেধাবী সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আগ্রহী হয়ে উঠবে, যার মধ্য দিয়ে লাভবান হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এবং অন্য সব স্তরের শিক্ষককেও অন্তর্ভুক্ত করে, একটি স্বতন্ত্র পে-স্কেলের ব্যবস্থা যত দ্রুত করা সম্ভব, ততই সমাজ ও জাতির মঙ্গল।
লেখক: ড. রাহমান নাসির উদ্দিন, নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।