গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবরে পরিবারের ৭ সদস্য ও কয়েকটি হাঁস-মুরগী নিয়ে রাতেই বাঁধে ছুটে আসেন কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার বুরবুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান। রাত থেকে পলিথিন দিয়ে ঘেরা একটি স্থানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তিনি বলেন, সরকারি কোনো খাদ্যসহায়তা পাইনি। শহর থেকে আসা একজন লোক রুটি কলা দিয়েছে। পাশে আশ্রয় নেওয়া প্রতিবন্ধী বিধবা হেলেনা তার বাড়ি দেখিয়ে জানালেন, ২ মেয়ে নিয়ে বাঁধে উঠে জীবন রক্ষা করেছি, কিছুই আনতে পারিনি। ঘরে যা ছিল সবই পানির নিচে। বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অন্য লোকজনেরও একই অবন্থা।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে বাঁধ ভাঙার পর দুর্গতদের সহায়তায় গতকাল শুক্রবার ৫টার দিকে প্রায় ১৭ ঘণ্টা পর সেখানে সরকারি ত্রাণসহায়তা পৌঁছানোর কথা জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে গোমতী বাঁধে গিয়ে দেখা যায়, ষোলনগল ইউনিয়নের বুরবুরিয়া নামক স্থানে ভাঙন এলাকার উভয় প্রান্তে অন্তত ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কিছুই আনতে পারেননি, কেউবা নিয়ে এসেছেন গরু, ছাগল আবার কেউবা হাস-মুরগী। বাঁধে একসঙ্গে ঠাঁই হয়েছে তাদের। বাঁধের ভাঙা অংশের উভয় অংশে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের বুরবুরিয়া, ইন্দবতী, বেড়াজাল, খাড়াতাইয়া, শিকারপুর, শ্রীপুর শিব রামপুর ও কিংবাজহুরা গ্রামের হাজারো নারী পুরুষ ও শিশু। এছাড়াও পানিবন্দি অবস্থায় বাড়িতে আটকে আছেন মহিষমারা, গাজীপুর, শিকারপুর, গোষাইপুর ও শিবরামপুর এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। উদ্ধারকর্মীরা তাদের আশ্রয়কেন্দ্র ও বাঁধে নিয়ে আসছেন।
বাঁধে আশ্রয় নেওয়া দিপক চন্দ্র বলেন, রাতে বাঁধ ভাঙার পর থেকে এখনো প্রশাসনের কাউকে তো দেখছি না। বাঁধ ভাঙার আগে বিকেল থেকেই প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হয়, কেউ সহায়তায় এগিয়ে আসেনি। পরিবারের ৫ সদস্য নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নেওয়া সফিক নামের এক ব্যক্তি বলেন, ঘরে থাকা ধান চাল সবই পানির নিচে। কোনোমতে ৩ সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে আসতে পেরেছি। এক ব্যক্তি পাউরুটি কলা দিয়েছে, তা দিয়ে দুপুর পর্যন্ত চালিয়েছি, রাতে কি খাবো জানি না।
দুপুর ১২টার দিকে নানুয়া বাজার মসজিদের পাশে কথা হয় খাড়াতাইয়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি ট্রলারযোগে বাড়ি থেকে আমাদের উদ্ধার করা হয়েছে। কিছু কাপড় ছাড়া আর কিছুই আনতে পারিনি। এখন কোথায় যাবো জানি না। ওই স্থানে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার কাজ তদারকি করছিলেন স্থানীয় ষোলনল ইউপি চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, বন্যায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের অন্তত ৩০ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চারটি আশ্রয়কেন্দ্রেও পানি উঠে যাচ্ছে। তাই এখন গোমতী বাঁধই ভরসা। ত্রাণ বিতরণের বিষয়ে তার ভাষ্য, গোমতী বাঁধে আশ্রয় নেওয়া দুর্গত লোকদের খাদ্যসহায়তা করতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবহিত করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত কোনো সরকারি খাদ্যসহায়তা পৌঁছেনি।
এদিকে বিভিন্ন গ্রামে আটকে পড়া লোকদের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে গোমতী বাঁধসহ নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বলেন, বন্যাদুর্গতদের জন্য এ উপজেলায় ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সকাল পর্যন্ত পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ৬০ হাজারেরও বেশী পরিবার। এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। বাঁধ ভেঙে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের মানুষ। পানিবৃদ্ধি হওয়ায় দুটি আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও পাশের পীরযাত্রাপুর, বুড়িচং সদর, বাকশিমুল ও রাজাপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে পানি ঢুকছে। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, পানি প্রবাহে ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবিদ্বার উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হতে পারে। সন্ধ্যার মধ্যে সরকারি ত্রাণসহায়তা হিসেবে শুকনো খাবার বিতরণ শুরু হবে বলেও তিনি জানান।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী বলেন, বুড়িচংয়ের বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় এক ট্রাক শুকনো খাবার পাঠনো হয়েছে।
এর আগে অতিবৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে জেলার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া নামক স্থান দিয়ে বাঁধটি ভেঙে যায়। বিকেল ৩টার দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান বলেন, গোমতীতে পানি কমতে শুরু করেছে, দুপুর ২টার দিকে পানি বিপৎসীমার ১০৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় ছিল বিপৎসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপরে। গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টায় গোমতীর পানি ছিল বিপৎসীমার ১২৯ সেন্টিমিটার ওপরে।