শরিয়াহ ব্যাংকিং রীতিতে ‘কর্জে হাসানা’ (কর্দ-এ-হাসানা) ব্যবস্থায় ঋণের বিপরীতে কোনো সুদ বা অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া যায় না। কেউ সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তাকে কিছু বলাও যায় না। মূলত সমাজের বিপদগ্রস্ত ও গরিব মানুষের জন্যই এই বিধান রাখা হয়েছে। দেশের নামকরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সিকদার গ্রুপ সেই সুবিধার আওতায় নিজেকে বিপদগ্রস্ত ও গরিব হিসেবে দেখিয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এফএসআইবিএল) থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সেই টাকা আর ফেরতও দিচ্ছে না। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে পড়ায় ব্যাংকটি আর কাউকে ঋণও দিতে পারছে না। সোমবার (১০ এপ্রিল) আজকের পত্রিকা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন জয়নাল আবেদীন খান।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে আরও কিছু অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। যেমন সরাসরি সিকদার গ্রুপের নামে এই ঋণ না নিয়ে বিভিন্ন বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয়েছে, যদিও অধিকাংশই সিকদার গ্রুপের। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ঋণের মোট পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৪৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকার ঋণকে গরিবের ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গ্রাহকের জমানো টাকা এভাবে সুদমুক্ত ঋণ হিসেবে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে দিয়ে শরিয়াহ ব্যাংক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফএসআইবিএলের পর্যবেক্ষক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুতাসিম বিল্লাহ বলেন, ব্যাংকটি এখন দুর্বল অবস্থায় আছে। তারল্যসংকটের কারণে ডিসেম্বর থেকে ঋণ বিতরণ বন্ধ রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে ভালোর দিকে যাচ্ছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীর সঙ্গে দেখা করতে গত ২৭ মার্চ এবং ২ এপ্রিল তাঁর
কার্যালয়ে গেলে কর্মকর্তারা জানান, তিনি এ নিয়ে কথা বলবেন না। পরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। বার্তা পাঠালেও জবাব দেননি।
এফএসআইবিএলের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান ড. মো. শাহজাদা বসুনিয়া বলেন, ‘ব্যাংকটির অনেক বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব নিয়ে বলার কিছু নেই। তবে তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন না করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এফএসআইবিএলের ২৪১তম বোর্ড সভায় ১ হাজার ৯৪৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ থেকে ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা কর্দে (কর্জ শব্দটিকে ‘কর্দ’ হিসেবে উল্লেখ করে ব্যাংক) স্থানান্তর অনুমোদন দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকেরা তদন্তে দেখতে পান, ঋণকে এভাবে কর্জে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় শর্ত মানা হয়নি। এই কর্জের অর্থ ব্যাংকটির দীর্ঘ সময়ের বিনিয়োগের অনাদায়ি বিনিয়োগ থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে; পাশাপাশি কর্জের অর্থ খেলাপি হিসেবে সন্দেহ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এফএসআইবিএলের বোর্ড সভায় যে ১৫টি প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৩৮২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণ কর্দে স্থানান্তর করা হয়, তার মধ্যে সিকদার গ্রুপেরই বিভিন্ন নামীয় প্রতিষ্ঠান। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: মেসার্স পারভীন হক সিকদার, পাওয়ারপ্যাক মুতিয়ারা জামালপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট লি., মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স জয়নুল হক সিকদার, পাওয়ারপ্যাক মুতিয়ারা কেরানীগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্ট লিমিটেড, নাসিম হক সিকদার, সিকদার রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড এবং এসকিউ ট্রেডার্স অ্যান্ড ডেভেলপার লিমিটেড।
প্রতিবেদনমতে, মেসার্স পারভীন হক সিকদারের ৭৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকার ঋণস্থিতির মধ্যে ৫৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা কর্দে স্থানান্তর করা হয়। পাওয়ারপ্যাক মুতিয়ারা জামালপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট লিমিটেডের ১৮৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকার মধ্যে ১২১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা কর্দে স্থানান্তর করা হয়। মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজের ঋণস্থিতি ১৫৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা; কর্দে স্থানান্তর করা হয়েছে ১৩৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। মেসার্স জয়নুল হক সিকদারের ৪১ কোটি ৬১ লাখ ঋণস্থিতির মধ্যে কর্দে স্থানান্তর করা হয়েছে ৪১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
এসব বিষয়ে কথা বলতে সিকদার গ্রুপ ও ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান মনোয়ারা হক সিকদারকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। দ্বিতীয়বার অন্য একজন ধরে ফোন করার কারণ জানতে চান এবং জানার পর সংযোগ কেটে দেন। এফএসআইবিএলের কর্দ গ্রাহক এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক পারভীন হক সিকদার এমপিকে ফোন করা হলে তিনিও ধরেননি। বিষয় উল্লেখ করে বার্তা পাঠানো হলেও জবাব মেলেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামি ব্যাংকিং নীতিমালায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মেয়াদবিহীন কর্জে হাসানা দেওয়ার সুযোগ নেই। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকে কর্জে হাসানায় স্থানান্তর বেআইনি। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কেবল ভালো কাজের উদ্দেশ্যে বিপদগ্রস্ত বা গরিব কিংবা অসহায়কে স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে কর্জে হাসানা দেওয়া যায়। সার্বিক পর্যালোচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এফএসআইবিএল কর্জে হাসানা অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করেছে।
কর্দের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সাবেক এমডি এবং শরিয়া ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ এম ফরিদউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী একেক সময় একেকভাবে বিনিয়োগ করে। তবে কর্দের ক্ষেত্রে সমপরিমাণের বেশি অর্থ আদায়ের সুযোগ নেই। তবে কী পদ্ধতিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকে কর্দে স্থানান্তর করেছে, তা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দরকার।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, কর্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ গ্রুপকে সুযোগ দিয়েছে এফএসআইবিএল। কর্দে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে যেসব অত্যাবশ্যকীয় শর্ত পালনীয় আছে, তা মানা হয়নি। এখানে একটি গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘদিনের অনাদায়ি বকেয়া ঋণকে নামেমাত্র ডাউন পেমেন্ট আদায়ের শর্তে আরোপিত মুনাফা মেয়াদহীনভাবে কর্জে হাসানা হিসাবে স্থানান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মুনাফা পরিশোধে বারবার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
ইসলামি ব্যাংকিংয়ে কোনো ঋণকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর্জ দেওয়া হলো কর্দ। কর্দকালের জন্য কোনো সুদ বা মুনাফা কার্যকর হবে না। কর্দ বা ধার দেওয়া টাকার বিপরীতে আমানত থাকতে হবে। এফএসআইবিএলের কর্দ বা ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো আমানত সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ধরনের কর্জ কত সময়ের জন্য দেওয়া হয়েছে, তা-ও উল্লেখ করা হয়নি। কাকে বা কোন প্রতিষ্ঠানকে কর্দ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করে ব্যাংকের শরিয়া কাউন্সিল। পরে বোর্ড এই ঋণ অনুমোদন দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাওয়ারপ্যাক মুতিয়ারা কেরানীগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্ট লিমিটেডের ১০৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ঋণস্থিতির মধ্যে কর্দে স্থানান্তর করা হয়েছে ৭৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। নাসিম হক সিকদারের ৯২ কোটি ৫২ লাখ টাকার মধ্যে ৭৩ কোটি ১ লাখ টাকা কর্দে স্থানান্তর করা হয়। সিকদার রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড ৩৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ঋণস্থিতির মধ্যে ২৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা কর্দে স্থানান্তর করা হয়। সিকদার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এসকিউ ট্রেডার্স অ্যান্ড ডেভেলপার লিমিটেডের ১৫১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার ঋণস্থিতির মধ্যে ৪১ কোটি ২৪ লাখ টাকা কর্দে স্থানান্তর করা হয়।
এফএসআইবিএলের গ্রাহক পারভীন সিকদার ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক। তাঁর মা একই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান। এখানে উভয় ব্যাংকের পরিচালকদের যোগসাজশে ঋণ বা বিনিয়োগকে কর্দে স্থানান্তর করা নিয়ে সন্দেহের সুযোগ রয়েছে। কেননা কোনো আইনেই মেয়াদের সীমা এবং বাড়তি অর্থ ছাড়া একটি শক্তিশালী গ্রুপকে ব্যাংক কর্দ দিতে পারে না।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংক তো আমানতকারীদের সঞ্চিত অর্থ নিয়ে ব্যবসা করে। সেখানে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্দ দেওয়ার সুযোগ নেই। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বশেষ ঋণ পুনঃ তফসিলের চার মেয়াদে ২৯ বছর পর্যন্ত ছাড় দিয়েছে। সীমাহীন সময়ের জন্য ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। এটা বড় অন্যায়। কার স্বার্থে এভাবে ঋণ বা বিনিয়োগকে কর্দে স্থানান্তর করা হলো, তা বোধগম্য নয়। এটার বিষয়ে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক?’