একবার কল্পনা করুন তো, দেশের ৩৯টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ যদি আলাদা আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিতো তাহলে একজন ভর্তি যোদ্ধার পক্ষে কয়টিতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হতো? কতো টাকা খরচ হতো? কতোটা হয়রান হতে হতো? কতোদিন সময় লাগতো সেই পরীক্ষা শেষ করতে? কিন্তু ভাগ্য ভালো মেডিকেল কলেজগুলো আলাদা করে পরীক্ষা নেয় না।
ফলে একদিনে একজন ভর্তিযোদ্ধা তার নিজ এলাকায় অবস্থিত মেডিক্যাল কলেজে বসে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তার স্কোর অনুযায়ী এবং মেডিক্যাল কলেজের র্যাঙ্ক অনুযায়ী দেশের যেকোনো মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের অধীনস্ত দেশের প্রায় ২ হাজার ২৫৪টি ডিগ্রি বা অনার্স কলেজে একই পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। অবশ্য আগে তারা ভর্তি পরীক্ষা নিতো। মাঝে কয়েক বছর উচ্চ মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি করেছে। আগামী বছর থেকে আবার তারা পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
তবে শিক্ষার্থীদের নানান জায়গায় দৌঁড়াতে হবে না। তাদেরকে নিজ এলাকার একটিমাত্র কেন্দ্রে পরীক্ষা দিলেই হবে। এতে করে ভর্তি যোদ্ধাদের সময়, অর্থ এবং হয়রানি কম হবে। এইদিকটি বিবেচনা করে শিক্ষাবিদদের লেখালেখি আর দাবির প্রেক্ষিতে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভুক্ত হয়েছিলো।
যেমন-কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ, প্রৌকশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ইত্যাদি। বেশ কয়েক বছর এইভাবে চলেছে। ভর্তিযোদ্ধারা এর সুফল পেয়েছে। অভিভাবকরা কম উদ্বিগ্ন হয়েছেন। যদিও দেশের বেশ কয়েকটি নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অহমিকা আর অর্থ লিপ্সার খোলস থেকে বেরিয়ে এসে গুচ্ছভুক্ত হয়নি। তারপরও যা হয়েছিলো তাতেও শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়েছে।
কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে অশনি সংকেত। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে গুচ্ছ ত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে। যেমন-খুলনা প্রৌকশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), রাজশাহী প্রৌকশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি), কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ইত্যাদি। আর একবার যখন গুচ্ছ ভাঙতে শুরু করেছে তখন ধরে নেয়া যায় বাকিরাও একই পথ ধরবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে লাভবান হবে। কিন্তু দেশের লাখ লাখ ভর্তিযোদ্ধাদের কী পরিমাণ হয়রানি ও অর্থদণ্ড হবে তা কী তারা ভেবেছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রত্যাশী আমাদের তরুণ শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের জন্য এই খবর সুখকর নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছভুক্ত থাকলে এবং আরো বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভুক্ত হলে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সময়, অর্থ, পরিশ্রম, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা কমতো।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে গড়ে এক হাজার থেকে বারশ টাকা খরচ হয়। এরপর যাতায়াত এবং সেখানে আবাসিক হোটেলে থাকা-খাওয়া। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের একাকী ছাড়েন না। তারাও সঙ্গে যান। এখন একজন অস্বচ্ছল পরিবারের পক্ষে তার সন্তানকে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ানো কীভাবে সম্ভব? গুচ্ছ ভেঙে যাওয়ার ফলে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষর্থীদের দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হবে।
এমনও দেখা গিয়েছে খুলনা জেলার একজন শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার জন্য আজ খুলনা থেকে রওনা দিয়েছে। আগামীকাল চট্টগ্রামে পরীক্ষা দিয়ে ওইদিনই রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা হতে হচ্ছে। হয়তো পরশুদিনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা। একবার ভাবুনতো ওই শিক্ষর্থীর শরীর ও মনের ওপর কতোটা চাপ পড়ে! আর তার পিতা-মাতার কতো উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ও অর্থদণ্ড হয়! এই সব দিক বিবেচনা করেই বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের প্রতিথযশা শিক্ষাবিদদের দাবি ও লেখালেখির ফলে এবং তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভুক্ত হয়েছিলো। কিন্তু এ বছর তারা আবার তাদের আগের সিদ্ধান্তে ফিরে যাচ্ছে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজেদের স্বার্থকেই বড় করে দেখছে। আমাদের কোমলমতি শিক্ষর্থীদের কথা তারা ভাবছে না। অর্থ বাণিজ্য আর আভিজাত্যের অহমিকা তাদের কাছে বড় বিষয়।
আভিজাত্যের অহমিকা এই অর্থে যে, গুচ্ছ পদ্বতিতে পরীক্ষা হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান অনুযায়ী র্যাঙ্কিংয়ের প্রশ্ন আসে এবং সে ক্ষেত্রে সবাই চায় এক নম্বরে থাকতে। ভর্তিযোদ্ধাদের জন্য স্বস্তির খবর হবে যদি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ইগো ও অর্থ চিন্তা পরিত্যাগ করে শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর স্বার্থ চিন্তা করে এই গুচ্ছ না ভাঙ্গে। সম্প্রতি আমাদের ছাত্রসমাজ বেশ প্রতিবাদমুখর। বিভিন্ন যৌক্তিক দাবিতে তারা সোচ্চার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আসার এই জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। আমরা অভিভাবকরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: উদ্বিগ্ন অভিভাবক, দোলখোলা, খুলনা