যে শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ জীবিকার্জনের জন্য কোনো একটি বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করে এবং শিক্ষা শেষে ওই বিষয়ে কর্মসংস্থান প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জন করে, তাই কর্মমুখী শিক্ষা। এই শিক্ষা ব্যক্তিকে কর্মসংস্থান প্রাপ্তির লক্ষ্যে বিশেষ কোনো কর্মে প্রশিক্ষিত করে একটি নির্দিষ্ট পেশা বা কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। এই শিক্ষা মূলত ব্যবহারিক, বাস্তবভিত্তিক ও জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা শুধু কর্মসংস্থানই নয়, একটি জাতির আর্থসামাজিক উন্নতির জন্যও অপরিহার্য। এ শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘কর্মমুখী শিক্ষা নিলে, বিশ্ব জুড়ে কর্ম মিলে’। এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিশেষ বিশেষ পেশায় দক্ষ করে তোলাসহ তাদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এর মতে, ‘কর্মমুখী শিক্ষা হলো এমন শিক্ষাব্যবস্থা যা শিক্ষার্থীদের জীবনকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে ও কর্ম পেতে সাহায্য করে’।
সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মমুখী শিক্ষা শিক্ষার্থীর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং তাদেরকে সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী করে গড়ে তোলে। এই শিক্ষার কাজ হলো জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তিকে সুদৃঢ় করা। কর্মমুখী শিক্ষা শিক্ষার্থীকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তাদের সুপ্ত গুণাবলীকে বিকশিত করে; শিক্ষার্থীর নৈতিক, সামাজিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করে; গণতন্ত্রমনা, দেশপ্রেমিক, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক তৈরি করে; কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে শিক্ষার্থীকে উপার্জনক্ষম করে গড়ে তোলে; স্বাধীন পেশা গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে। কর্মমুখী শিক্ষার ওপর যতো বেশি গুরুত্বারোপ করা হবে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ততো ত্বরান্বিত হবে। আধুনিক বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে চাহিদার প্রেক্ষিতে কর্মসংস্থানের ধারণা ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত এমন সব কাজের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে যেগুলোর সঙ্গে বিশেষায়িত শিক্ষার আবশ্যকীয়তা জড়িয়ে আছে। ফলশ্রুতিতে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী বা জীবনমুখী শিক্ষা অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে। কর্মমুখী শিক্ষা এমন এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা, যা গ্রহণ করতে পারলে শিক্ষার্থীরা ঘরে-বাইরে, ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায় যেকোনো পেশায় অতি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার যোগ্যতা লাভ করে। এই শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান মূলত পেশাগত কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শিক্ষা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণের পর একজন শিক্ষার্থীকে চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। আর এ শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের মধ্য দিয়েই দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন সম্ভব।
উচ্চতর কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ইচ্ছামতো একটি স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত হতে পারে বা ভালো বেতনে উচ্চপদস্থ পেশাজীবী হওয়ার সুযোগ পায়। যেমন- প্রকৌশলী, চিকিৎসক, অধ্যাপক, কৃষিবিদ ইত্যাদি। সাধারণ কর্মমুখী শিক্ষায় পেশাজীবী হতে চাইলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতাই যথেষ্ট। এই শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনশেষে একজন শিক্ষার্থী কৃষি খামারি, মৎস্য চাষি, কামার, কুমার, তাঁতি, দর্জি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, পেইন্টার, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, টাইলস মিস্ত্রি, প্লাম্বার, পোষাক কারখানা শ্রমিক, ছাপাখানা শ্রমিক, চামড়া শিল্পের শ্রমিক, কুটির শিল্প, নার্সারি মালিক, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, নার্স, ধাত্রী, গাড়ি চালক, সাইকেল-রিকশা ইত্যাদি মেরামতের কাজ, দোকানদার, সেলসম্যান, হেয়ার ড্রেসার, মেকানিক, ওয়েল্ডার, রেডিও-টেলিভিশন-ফ্রিজ-মোটরগাড়ি ইত্যাদি মেরামতের কাজ, বৈদ্যুতিক গৃহসামগ্রী মেরামতের কাজ, হাউস ওয়ারিং, যানবাহন চালক, প্রাথমিক চিকিৎসার কাজ, কাপড় ইস্ত্রির কাজ, আধুনিক পদ্ধতিতে হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল ও ভেড়ার খামারি, সেলুনের কাজ ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত হতে পারেন। এ শিক্ষা অল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে সহজেই গ্রহণ করা যায় এবং দেশ ও বিদেশের সর্বত্রই এ ধরনের কাজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা পরিকল্পিত, কর্মমুখী, আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল নির্ভর। বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার ফলে আমেরিকা, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ আজ নিজেদের জীবনমানকে সুপ্রসন্ন করে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। বাংলাদেশ বিশেষত, শিক্ষা-দীক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দিক থেকে অনেকটা পশ্চাদপদ ও অনগ্রসর। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সীমিত সম্পদের ওপর চাপ পড়ার কারণে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশে এখনো ব্রিটিশদের প্রচলিত কেরানি বানানোর সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে যা কর্মভিত্তিক না হওয়ায় প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষিত হয়েও বেকার থাকছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুন মাসে এদেশে বেকারত্বের হার ছিলো ১২.৫৪ শতাংশ। সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠির মধ্যেই বেকারত্বের হার বেশি। অথাৎ যার শিক্ষাগত যোগ্যতা যতো বেশি তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ততো কম। যারা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন তাদের বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর যারা অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আমাদের শিক্ষার্থীদের মূল টার্গেট হলো একাডেমিক সার্টিফিকেট পাওয়া, কিংবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, যোগ্যতা ও দক্ষতাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। এ কারণে উচ্চশিক্ষিত হয়েও থাকতে হচ্ছে বেকার, মিলছে না চাকরি। বিদেশে গিয়েও অন্য দেশের কর্মীদের তুলনায় কম বেতনে চাকরি করছে। এ অবস্থার পরিবর্তনে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষার প্রবর্তন করা গেলে বেকারত্বের হার কমবে এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। কর্মমুখী শিক্ষাই বেকারত্বের নিদারুণ অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারবে।
জাতীয় জীবনে কর্মমুখী শিক্ষা বাস্তবায়নের পেছনে বেশ কিছু সীমাবদ্বতা রয়েছে। যেমন-কৌশলগত পরিকল্পনা ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব; প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শিক্ষক, লোকবল, শিক্ষা উপকরণ, জনসচেতনতার অভাব; আর্থিক ব্যয় সংকুলান ব্যবস্থা ও গুণগত মানোন্নয়নে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অভাব; অনেক প্রতিষ্ঠানেই আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের সুযোগের অভাব, কর্মসংস্থানমুখীকরণের জন্য উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানার সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আমাদের সমাজে অনেকেই মনে করেন, কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। তাই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের মেধাবী সন্তানদের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করেন আর দুর্বল মেধার ছেলেমেয়েদের কারিগরি বা কর্মমুখী শিক্ষায় ভর্তি করান। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা সাধারণ শিক্ষায় যতোটা না উন্নত, তার চেয়ে বেশি উন্নত যুগোপযোগী কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষায়।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশেও কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে।
সারা বিশ্ব উৎপাদনমুখী কারিগরি শিক্ষা এবং কর্মমুখী শিক্ষার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে চীনে ১৭ হাজার ৭৭০টি কারিগরি প্রতিষ্ঠান ছিলো; যাতে অধ্যয়নরত ছিলেন ১ কোটি ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী। কারিগরি শিক্ষার প্রসারের ফলে তাদের পণ্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে লেদার, প্লাস্টিক, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইল, এয়ারলাইনস, নার্সিং এসবে চাহিদা থাকলেও আসন সংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে এই খাতগুলোতে পর্যাপ্ত মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে না। ফলে বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশে থেকে দক্ষ শ্রমিক জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, বরং অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রমিক বিদেশে গিয়েই কাজ শেখেন। কিন্তু অন্যান্য দেশ থেকে যারা শ্রমবাজারে আসেন তারা কাজ শিখে, সার্টিফিকেট নিয়ে বিদেশে যান। ফলে তাদের বেতন বাংলাদেশিদের তুলনায় অনেক বেশি। একই পরিমাণ রেমিট্যান্স তৈরিতে প্রায় দ্বিগুণের বেশি অদক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে হয়।
বাংলাদেশে কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া দরকার তা হলো-দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে আরো বেশি বিনিয়োগ; পর্যাপ্ত মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কর্মমুখী কাজে আগ্রহী করে তোলা; শিল্পকারখানার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ শিক্ষানীতি প্রণয়ণ করে শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা; সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব মডেলের আওতায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা; চাহিদার নিরীখে বাজেট বাড়ানো; কর্মমুখী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা, ইত্যাদি।