চাকরিজীবিদের কর্মস্থল পরিবর্তনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, ব্যক্তি তার ভালোমন্দ বিচার করে চাকরি পরিবর্তন করে থাকেন। এটা বিশ্বব্যাপী ধারা।
বাংলাদেশেও এর হার মোটেও কম নয়। তবে এ কথা সত্য যে, কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় চাকরি পরিবর্তন যতোটা না হয়ে থাকে, তার থেকে বেশি হয়ে থাকে ব্যক্তির ইচ্ছা বা খামখেয়ালিপনায়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের একটি গবেষণায় জানা গেছে, ৩৪ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের মাঝে ৭৫ শতাংশেরও বেশি সংখ্যক চাকরি পাল্টানোকে তাদের ক্যারিয়ারের জন্য ভালো মনে করে।
ব্যক্তির খারাপ পারফরম্যান্স, কর্মক্ষেত্রের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সময়মত পদোন্নতি-বেতনবৃদ্ধি না হওয়া, সহকর্মীদের অসহযোগিতামূলক মানসিকতা, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্বপূর্ণ আচরণের কারণে মানুষের মধ্যে চাকরি পরিবর্তন করার প্রবণতা দেখা দেয়। আবার কখনো কখনো ব্যক্তির দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও ভালো কর্মের সুনামের কারণে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে তাকে উচ্চবেতন ও উচ্চপদের প্রস্তাব করার কারণে মনুষ কর্মস্থল পরিবর্তন করে।
বলা বাহুল্য, চাকরি ছাড়া বা কর্মস্থল পরিবর্তন করার কারণ যাই থাক না কেনো, এটির সুবিধা-অসুবিধা দুটিই রয়েছে। আমরা যদি চাকরি পরিবর্তনের ভালো দিকটি চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই যে চাকরি পাল্টানোর ফলে ব্যক্তি নানাভাবে লাভবান হচ্ছেন। যেমন-১. আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বৃদ্ধি করে: চাকরি পরিবর্তনের কারণে ব্যক্তি তার যোগ্যতা প্রকাশের একটি নতুন সুযোগ লাভ করে। কর্মক্ষেত্রের নতুন পরিবেশ ও নতুন কর্মকৌশল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করায় ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের নতুন উদ্যম কাজ করে, ফলে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও মনোবল আরো বৃদ্ধি পায় এবং নতুন কর্মস্থলে সবার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে সে স্ব-মহীমায় নিজেকে কর্তৃপক্ষের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
২. মাঝেমধ্যে চাকরি পরিবর্তন করলে ব্যক্তির নিজস্ব কর্মদক্ষতা ও পেশাদার সক্ষমতা তৈরি হয়। এটা ব্যক্তিকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয় এবং নতুন কর্মস্থলের ব্যতিক্রমী কোনো পদ্ধতি থাকলে সেটি আয়ত্ত করতে সাহায্য করে। ফলে তার প্রফেশনাল স্কিল, পারসোনাল স্কিল এবং মোরাল স্কিল উন্নত হয়, যা তার বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতিতে সাহায্য করে। নিয়মিতভাবে কর্মস্থল ও কাজের পরিবেশ পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে এবং স্কিলগুলোকে আরো তীক্ষ্ণ করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া, ইন্ডাস্ট্রির যাবতীয় তথ্য ও সাম্প্রতিক ট্রেন্ড সম্পর্কে ধারণা লাভ করায় তার আরো দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৩. চাকরি পরিবর্তন করে ভিন্ন কোনো সংস্থায় কাজ করতে গেলে নিজেকে প্রকাশ করার একটি সুযোগ তৈরি হয়। তখন দীর্ঘ দিনের অনুশীলিত নিজের সহজাত পরিবেশের বাইরে গিয়ে সে কাজ করতে পারে। তা ছাড়া, নতুন চাকরি মানেই নতুন পরিবেশ, নতুন ধরনের কাজ ও দায়িত্বে ভিন্নতা। সেখানে মানিয়ে নিতে ও ভালো পারফর্ম করতে সবারই একটু বেশি চেষ্টা করে নিজেকে সফল কর্মী হিসেবে প্রমান করতে হয়, এটি একটি আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির উপায়ও বটে। একই পজিশনে দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে অনেক সময় আমরা তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাই। চাকরির পরিবর্তন সেই অভ্যস্ততা থেকে বের করে ভিন্ন ও নতুন কিছু উপভোগ করার সুযোগ করে দেয় এবং অন্যরকম পরিবেশ ও ভিন্ন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষদের মাঝে কাজ করার নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হওয়ায় ব্যক্তির আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
৪. একই বেতন কাঠামোয় দীর্ঘদিন কাজ করলে ব্যক্তির কাজের আগ্রহ হারিয়ে যায়। তাই সে হয়তোবা চাকরি পরিবর্তনের চেষ্টা করে। আর এটি হয় তার উচ্চতর স্কেলে বেতন বৃদ্ধির অন্যতম সুযোগ। কারণ, দ্রুত চাকরি পরিবর্তন করা যেমন ব্যক্তির অনেক কিছু শেখার সুযোগ করে দেয়, তেমনি তার উপার্জনও বাড়াবে তাড়াতাড়ি। ক্যামেরন কেং-এর মতে, যেসব চাকুরেরা একই কোম্পানিতে দুই বছরের বেশি চাকরি করেন, তাদের বেতন অন্যদের থেকে প্রায় ৫০ শতাংশ কম হয়। সুতরাং চাকরির পরিবর্তন উচ্চতর বেতন বৃদ্ধির সুবর্ণময় সুযোগ।
৫. নতুন চাকরি মানেই নতুন এমপ্লয়ার ও সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় এবং নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ। নিয়মিত চাকরি পরিবর্তন ব্যক্তিকে একটি বিশাল প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক গড়ার সুযোগ করে দেয়, যা পরবর্তীতে চাকরি খোঁজাসহ আরো অনেক সমস্যা সমাধানে তার কাজে লাগতে পারে। তবে এ নেটওয়ার্ক ধরে রাখার জন্য সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। চাকরি ছাড়ার সময় কারোর সঙ্গে কোনোরকম খারাপ আচরণ করা বা কোম্পানিকে অসুবিধায় ফেলে রেখে যাওয়া প্রফেশনাল নেটওয়ার্কে আপনাকে নেতিবাচক পরিচিতি দিতে পারে।
৬. দীর্ঘদিন এক জায়গায় এবং একই পজিশনে চাকরি করলে মানসিক অস্বস্তির সৃষ্টি হয় এবং কাজে একঘেয়েমি ভাব তৈরি হয়। চাকরি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির কাজের পরিবেশ এবং দায়িত্বেও পরিবর্তন আসে, যা তার প্রফেশনের দিকে আগ্রহ ধরে রাখতে খুবই কার্যকরী। নতুন কোনো প্রজেক্টের শুরুতে কর্মী যেমন উদ্যমের সঙ্গে কাজ করে, নিয়মিত চাকরি পরিবর্তন তাকে নিয়মিতভাবে সেই অনুভূতি উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়।
অন্যদিকে, চাকরি পরিবর্তনের যেমন ভালো দিক রয়েছে, ঠিক তেমনি এর কিছু মন্দ দিকও রয়েছে। যেমন-১. বার বার চাকরি পরিবর্তনের কারণে নিয়োগকর্তারা নতুন চাকরি প্রার্থী ব্যক্তির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। নিয়োগকর্তারা সবসময় দীর্ঘমেয়াদী কর্মীদের হায়ার/নিয়োগ করতে চান। কারণ, যেকোনো পজিশনে নতুন চাকরিজীবী নিয়োগ দেয়া সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।
২. চাকরি পরিবর্তন করে নতুন চাকরি খুঁজে নিতে ব্যক্তিকে অনেক বিড়ম্বনার স্বিকার হতে হয়। এমনকি বারবার চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে দিতে যখন সে ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন সে হতাশায় আক্রান্ত হতে পারে এবং পুনরায় কোথাও চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ভয় পায়। এভাবে সে একদিন চাকরি পরিবর্তনের কারণে বেকার হয়ে যেতে পারে এবং তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে হতাশা ও অশান্তি নেমে আসতে পারে।
৩. যারা কিছুদিন পর পর চাকরি পরিবর্তন করে, তাদের সাধারণত একটি পজিশনে থেকে বড় কোনো সাফল্য অর্জনের উদাহরণ কম থাকে। এটি উচ্চ ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। নিজের সাফল্যকে যদি তার বায়োডাটা বা সিভিতে উপস্থাপন করতে না পারে, তাহলে একই চাকরিতে আবেদন করা অন্যদের তুলনায় তার চাকরি প্রার্থিতা দুর্বল হয়ে যায়। আবার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা বা চাকরি পরিবর্তনের ইতিহাস অনেক লম্বা হলে চাকরিদাতারা সে প্রার্থী বাছাই করতে ভীষণ অপছন্দ করেন। এক্ষেত্রে বার বার চাকরি পাল্টানো এবং পূর্ববর্তী চাকরি ছেড়ে দেয়ার যথাযথ কারণ প্রদর্শন খুবই জরুরি হয়ে পড়ে, যা নিয়োগকর্তাদের জন্য বিব্রতকর।
৪. চাকরি পরিবর্তনকারী ব্যক্তির যোগ্যতা যতোই বৈচিত্র্যময় হোক এবং অভিজ্ঞতা যতোই দীর্ঘ হোক, একটা নতুন কোম্পানিতে কাজ শুরু করার সময় তাকে নতুন জিনিস শিখতেই হবে। দীর্ঘদিন এক জায়গায় চাকরি করলে সেই কোম্পানির কার্যপদ্ধতি ও বাণিজ্যিক মডেল সম্পর্কে যে বিশেষজ্ঞতা তৈরি হয়, তা বার বার চাকরি পরিবর্তন থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে তার মধ্যে কর্মের কৌশলগত একটি জ্ঞানের শুন্যতা তৈরি হয়। টেকনিক্যাল ও টেকনোলজিক্যাল জ্ঞানের ক্ষেত্রেও এটা একই ভাবে সত্যি। একটি প্রজেক্টের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করা আপনাকে সেই প্রজেক্ট ও এতে ব্যবহৃত স্কিলগুলোয় গভীরতর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ দেবে। মাঝপথে চাকরি পরিবর্তন করে অন্য প্রজেক্টে চলে গেলে তা হয়তো সম্ভব হবে না।
৫. নতুন জায়গায় চাকরি করা মানে নিজেকে সবকিছুই নতুন করে শুরু করতে হবে। কোম্পানির সংস্কৃতি ও কার্যপদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হতে হবে, নতুন মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, নতুন প্রজেক্টের কাজ বুঝে নিতে হবে এবং প্রয়োজনে তার দৈনন্দিন রুটিনেও পরিবর্তন আনতে হবে। এসব কিছুর পাশাপাশি টিমের নতুন সদস্য হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে তাকে পরিশ্রমও করতে হবে আগের চেয়ে বেশি। একই কোম্পানিতে অনেক দিন কাজ করলে যেমন প্রমোশন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, যা তার নতুন চাকরিতে পাওয়াটা কঠিন হয়ে যায়।
৬. চাকরি পাল্টিয়ে নতুন চাকরি খোঁজা, ইন্টারভিউ দেয়া, নতুন কোম্পানিতে মানিয়ে নেয়া অথবা কোনো ইন্টারভিউ থেকে প্রত্যাখ্যান পত্র গ্রহণ করা; সবই মানসিকভাবে মেনে নেয়া বেশ কঠিন। প্রতিটি ধাপেই অনেক পরিশ্রম ও সংকল্প নিয়ে লেগে থাকতে হয়। বার বার চাকরি পরিবর্তন করতে গেলে কাজটা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলস্বরূপ চাকরি খোঁজা ও ইন্টারভিউ দেয়ার প্রক্রিয়ায় আপনার আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে যেটি বোধগম্য, সেটি হলো চাকরি পরিবর্তন করা বা না করা ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। কর্মজীবনের যে সুবিধাগুলোকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, তার ওপর নির্ভর করেই নিতে হবে চাকরি পরিবর্তন করা বা না করার সিদ্ধান্ত। তবে সিদ্ধান্ত যাই হোক, চাকরি ছাড়ার পর পূর্ববর্তী কর্মস্থলের সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখা অত্যন্ত আবশ্যক। যে পরিবর্তন নিজের ক্যারিয়ার উন্নয়নের জন্য উত্তম সেটিই করা উচিত। আমার মতে, নিজের কর্মস্থলে যদি নিজের সঠিক মূল্যায়ন নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠে, তাহলে কর্তৃপক্ষের সান্যিধ্য অর্জনে যথাসাধ্য চেষ্টা করে নিজের অবস্থান দৃঢ় করা, অথবা চাকরি পরিবর্তন করে নিজের ক্যারিয়ারের উন্নয়নে সচেষ্ট হওয়া।
লেখক: অধ্যক্ষ