চা-বাগানের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সারদা রানী - দৈনিকশিক্ষা

চা-বাগানের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সারদা রানী

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি |

চরাচর ছাপিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। সঙ্গে আছে ঝড়। ভিজে যাচ্ছে কমলগঞ্জের আলীনগর চা-বাগানের ছায়াবৃক্ষ আর তার তলায় দাঁড়িয়ে থাকা চাগাছ। বেশ কয়েকজন চা-শ্রমিক সেই ঝড়বৃষ্টি থেকে নিজেদের বাঁচাতে বাগানের টিলা বাবুর ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়ান। স্কুল থেকে মায়ের সঙ্গে সে পথেই বাড়ি ফিরছিল কিশোরীটি। সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। অন্য শ্রমিকদের দেখে তারাও টিলা বাবুর বারান্দায় এসে দাঁড়ায়—খানিক সাহসে ভর করে। টিলা বাবু এলেন। সেই ঝড়-তুফানের মধ্যেই বারান্দা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলেন শ্রমিকদের। মায়ের সঙ্গে থাকা কিশোরীটিকেও বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বারান্দা থেকে নেমে যেতে হলো একরাশ অপমান সহ্য করে। সেদিনই কিশোরীটি প্রতিজ্ঞা করেছিল, একদিন সেই চা-বাগানে সে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হবে, চাকরি করবে শ্রমিকের জীবন ছেড়ে। 

সেদিনের সেই কিশোরীটির নাম সারদা রানী গোয়ালা। তাঁর সেই প্রতিজ্ঞা বৃথা যায়নি। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাস করে বাংলাদেশের চা-শ্রমিকের সন্তানদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন তিনি।

আলীনগর চা-বাগানে এক শ্রমিক পরিবারে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর জন্মেছিলেন সারদা রানী গোয়ালা। মা কুমারী গোয়ালা ছিলেন চা-শ্রমিক। দৈনিক ১০ টাকা মজুরিতে চা-বাগানে কাজ করতেন। আর বাবা টুকটাক কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিলেন। চার বোনের মধ্যে সারদা ছিলেন সবার ছোট। আলীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল তাঁর।

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময় চা-বাগানে কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও পড়ালেখার মান ছিল শূন্যের কোঠায়। চা-শ্রমিকের সন্তানেরা উচ্চবিদ্যালয়ে যাওয়ার আগেই প্রায় শতভাগ ঝরে যেত শিক্ষাজীবন থেকে। কিন্তু সারদার বাবা ঠিক করেছিলেন, ছোট মেয়েকে পড়ালেখা শেখাবেন। তাই আলীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সারদাকে ভর্তি করান তিনি। প্রাথমিকের পাট চুকে গেলে বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের শমশেরনগর এএটিএম বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করানো হলো। স্কুলে ভর্তির পর এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল চা-বাগানে। মেয়েকে হাইস্কুলে ভর্তির দিন বাগানের বেশির ভাগ মানুষ সারদার বাবা ও পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করে একঘরে করে দেয়!

বাগানের লোকজনের কথাবার্তা শুনে সারদার বাবা অনেকটা ভেঙে পড়েন। সহায় হয়ে সামনে আসেন সারদার প্রাইভেট শিক্ষক দিলীপ ভট্টাচার্য। তিনি সারদার বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে মেয়ের লেখাপড়ার পথ বন্ধ করা যাবে না, লোকে যা-ই বলুক না কেন। এর পর থেকে সারদার বাবা মেয়েকে শিক্ষিত করার জন্য শেষ পর্যন্ত কষ্ট করে গেছেন।

১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে শমশেরনগর এএটিএম বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর এইচএসসিতে কমলগঞ্জ গণমহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন সারদা। সেখান থেকে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি এবং ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাস করেন। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান জুড়ী উপজেলার কাপনা পাহাড় চা-বাগানের দুর্গা প্রসাদ যাদবের সঙ্গে বিয়ে হয় সারদার। বিয়ের পর ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাস্থ্য সহকারী পদে কুলাউড়া উপজেলায় চাকরিজীবন শুরু করেন। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে চাকরি থেকে অবসর নেন সারদা রানী গোয়ালা।

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে সারদার স্বামী দুর্গা প্রসাদ যাদব মারা যান। দুই ছেলেসন্তান আছে তাঁদের। বড় ছেলে সরকারি এবং ছোট ছেলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। বড় ছেলের স্ত্রী একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।

তাঁদের নিয়েই স্বামীর বাড়িতেই বসবাস করছেন সারদা।

চা-বাগানের নির্জন পরিবেশে সারদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় চলে যায়। এর মধ্যেই অনেক দীর্ঘশ্বাস পড়ে তাঁর। কখনো হন উচ্ছ্বসিত। কখনোবা ভবিষ্যতের ভাবনায় তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সারদা বলেন, ‘আমি চাই, বিশেষ করে চা-বাগানের মেয়েরা যেন লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর জীবনকে যেন সীমাবদ্ধ না রাখে। পড়ালেখা করে নিজের জীবন নিজেকেই গড়তে হবে। আমি যে সময় স্কুল-কলেজে গিয়েছি, তখন অনেকেই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। তবুও আমি থামিনি।’

সারদা রানী গোয়ালার কথা কি চা-বাগানের প্রান্তরে প্রান্তরে পৌঁছাবে?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত - dainik shiksha প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি - dainik shiksha আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির - dainik shiksha আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি - dainik shiksha পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান - dainik shiksha ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003882884979248