সাফল্য ও গৌরবের ১৯টি বছর পার করলো উচ্চশিক্ষা বিস্তারে সময়ের সেরা বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। আজ ২০ অক্টোবর ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’। সুদীর্ঘ দেড়শ’ বছরেরও বেশি পুরোনো পুরান ঢাকার এই প্রতিষ্ঠানটি সংস্কৃতির ধারক-বাহক। গৌরব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যে এ প্রতিষ্ঠানের অবদান কম নয়। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে গণহত্যা চালানো হয়। যুদ্ধ শেষে পাওয়া যায় গণকবর। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের অবৈতনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ব্রাহ্ম স্কুল’ সময়ের পরিক্রমায় আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ অক্টোবর একরাশ স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু করে। পথচলার শুরুতে নানাবিধ সংকট থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিপূর্ণ, আধুনিক ও বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শর্তাবলি আবশ্যক, সে পথেই এগিয়ে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, যুগোপযোগী জ্ঞান বিতরণ, অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ও সমতা অর্জন, আধুনিক জ্ঞান ও সংস্কৃতির চর্চা, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব প্রদানে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সাতটি অনুষদের অধীনে ৩৮টি বিভাগ ও দুইটি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭ হাজারের বেশি। ৭০০-এর অধিক শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যৌথ উদ্যোগে এমফিল ও পিএইচডি গবেষকরা গবেষণাকর্মের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প-সংস্কৃতি, সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম ও সুকুমারবৃত্তি চর্চার জন্য রয়েছে ১২টি প্রতিষ্ঠান।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে শিক্ষক থেকে এবারই প্রথম উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সমাজকর্ম বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম। একটি পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের যেসব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া দরকার সে তুলনায় কিছুটা হলেও পিছিয়ে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষার্থীদের পরিবহন সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ক্যানটিনও নানা সমস্যায় নিয়মিতভাবে খোলা থাকে না। ক্যানটিনে খাবারের দাম চড়া। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, দেশসেরা অন্যতম এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রধান সমস্যা হলো আবাসন সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আবাসন সংকটের সমাধানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে বরাবরই উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের আসন সংখ্যাও সীমিত। প্রশ্ন হলো, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবাসন সুবিধা পেলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবে কেনো ? আবাসন সুবিধার আশায় শিক্ষার্থীদের ১৮টি বছর কেটে গেলো। ঢাকার কেরানীগঞ্জে ২০০ একর জমির ওপর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজ নিয়ে কালক্ষেপণ কম হয়নি। জমি অধিগ্রহণের কাজ হয়ে গেলেও গতি পায়নি অবকাঠামোগত কাজ। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মাঠ (ধূপখোলা) হাতছাড়া হয়ে যায়। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ কীভাবে বেদখল হয়ে গিয়েছিলো তার কোনো উত্তর কেউ দেয়নি। সম্প্রতি জুলাই-আগস্টে স্মরণকালের আন্দোলনের পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মাঠটি জেলা প্রশাসন আবার জবি কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জবি শিক্ষার্থীদের অবদান ছিলো চোখে পড়ার মতো। জবি প্রশাসনও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ও শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে জবি ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। এমন সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে মনে করি।
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করে চলেছে। তবে গবেষণা কার্যক্রমে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। খুশির সংবাদ হলো, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা আয়োজিত নাসা স্পেস অ্যাপস-২০২৪ প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জবি। এছাড়া এ বছর ‘আন্তবিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতিবিরোধী বিতর্ক’ প্রতিযোগিতার ফাইনালে ঢাবিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন জবির বিতার্কিকরা। এমন টুকরো টুকরো সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। লেখাপড়া শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বিসিএস, জজ, ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জবি শিক্ষার্থীদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য।
জবির পুরো ক্যাম্পাস ইন্টারনেটের আওতায় যুক্ত করা হয়েছে। ই-বুক সিস্টেম চালু হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বই ও গবেষণা পত্রিকা সহজেই পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা আরো আধুনিক করা দরকার বলে মনে করি। দুঃখের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্র সংসদের কথা উল্লেখ নেই। শিক্ষার্থীদের অধিকার ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্র হলো ‘ছাত্রসংসদ’। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ থাকবে না- এটা হতে পারে না। ছাত্রদের কল্যাণে জবির ছাত্র সংসদের নির্বাচন সময়ের দাবি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাবর্তনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আকাঙ্ক্ষিত প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি। প্রতিবছর সম্ভব না হলেও অন্তত দুই-তিন বছর পরপর যাতে সমাবর্তন আয়োজন করা যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। দেড়’শ বছরের অধিক সময় ধরে ঐতিহ্য বহন করা এ ক্যাম্পাস উপমহাদেশের গর্ব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যার নামে স্কুল থেকে তিলে তিলে গড়ে উঠলো আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সেই জগন্নাথ জমিদারকে বছরের একটা দিনের জন্য কিংবা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও স্মরণ করা হয় না! তৎকালীন জমিদার জগন্নাথের জন্ম বা মৃত্যুদিনে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবাষির্কীতে জগন্নাথের জীবনাকর্ম নিয়ে আলোচনা করার দাবি জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে ইতিহাস বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ দাবি করা নিশ্চয় অমূলক নয়। ইতিহাস-ঐতিহ্য বজায় রেখে নিত্যনতুন গবেষণা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। তবে সবার আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও উচিত সব শিক্ষার্থীদের দ্রুত আবাসন সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। ঢাকার কেরানীগঞ্জে ২০০ একর জমির ওপর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণ যত দ্রুত সমাপ্ত হবে তত দ্রুতই শিক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আবাসন সমস্যার সমাধান হলে শিক্ষার্থীদের অনেক দিনের স্বপ্ন যেমন পূরণ হবে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ আরো উন্নত হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা ও গবেষণার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, শান্তিপ্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাবে- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়