জামায়াত নিষিদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের একটি অতীত নির্দেশনা - দৈনিকশিক্ষা

জামায়াত নিষিদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের একটি অতীত নির্দেশনা

মিজানুর রহমান খান |

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের বিচার চলছে তখন। কারো ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। কারো রায় প্রদানের সময় আসছে ঘনিয়ে। সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের বেশুমার সহিংসতা। উঠছে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধের জোর দাবি। সে সময়ই বিশেষ কিছু লেখা চমকে দিলো সবাইকে। যেগুলোর  লেখক ছিলেন সংবিধান, আইন ও সংসদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান। সেগুলোরই একটি এই প্রতিবেদন। সময়ের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে সেই কালজয়ী লেখাটি ফের প্রকাশ করা হলো। 

আদালতের রায়ে আমরা পঞ্চম, সপ্তম সংশোধনী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হতে দেখেছি। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ শাহবাগ আন্দোলনকেও আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে, জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট বিচারাধীন। এটি নিষ্পত্তি করতে গিয়ে হাইকোর্ট কোনো নির্দেশনা দিতে পারেন। আর তখন এর ভিত্তিতে জামায়াতের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গত ফেব্রুয়ারিতে (২০১৩) এই রিটের সুরাহা হবে মর্মেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। শাহবাগ আন্দোলন আলটিমেটাম দিয়েছে, ২৬ মার্চের মধ্যে জামায়াত নিষিদ্ধ করতে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হক হানিফ বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। কিন্তু, জামায়াত নিষিদ্ধে সিদ্ধান্ত তখন হয়নি। বরং এ নিয়ে দিনক্ষণ দিয়ে বক্তব্য রাখায় প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের বৈঠকে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এই বৈঠকেই আলোচনা হয়েছে, জামায়াত নিষিদ্ধে সরকার ‘আদালতের নির্দেশনার’ বাইরে কিছু করবে না। নির্বাহী আদেশে বা সংসদে আইন পাস করে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবকিছু আইনের দৃষ্টিতে দেখতে হবে।’ সর্বশেষ ড. আনিসুজ্জামান, আকবর আলি খানসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের একটি দলও জামায়াতকে নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন।

নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধকরণ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। হাইকোর্টের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। কিন্তু এটি নিষিদ্ধকরণে তাঁর নির্দেশনা দেওয়ার সুযোগ থাকার কথা নয়। এমনকি শাহবাগ রেনেসাঁর পটভূমিতে ১৯৭৩ সালের আইনটিও গোঁজামিল দিয়ে সংশোধন করা হলো। যুদ্ধাপরাধী সংগঠনকে ট্রাইব্যুনাল কী শাস্তি দেবে, সংসদ তা বলেনি। মেননের আকস্মিক সংশোধনীর পরে আবার চুপ করে যাওয়া থেকেও বোঝা যায়, তাঁরা উপযুক্ত করণীয় সম্পর্কে ধাঁধায় আছেন।

প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর এ রকম বিচার বিভাগনির্ভরতা প্রসঙ্গ আমাদের ৪৯ বছর আগের একটি উপাখ্যান মনে করিয়ে দিয়েছে। সেটা ছিল আইয়ুব খানের আমল। তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ওই নিষিদ্ধকরণের প্রক্রিয়াটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও গোঁজামিলসর্বস্ব। 

তখন একটা নাটক করা হয়েছিল। সেই নাটক আমরা শুনব। কারণ আমরা এই পর্বে কোনো নাটকীয়তা কিংবা হঠকারিতা দেখতে চাই না। ন্যায্য, বাস্তবসম্মত ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় উপযুক্ত পদক্ষেপ দেখতে চাই। বুমেরাং মার্কা কিছু চাই না।

কোনো যুদ্ধাপরাধী সংগঠন, এমনকি যারা ক্ষমতা পেলে আমাদের সংবিধানের গলা কাটবে, তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন অমীমাংসিত। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন ও ধর্মীয় সংগঠনের মধ্যে পার্থক্যটাও সুস্পষ্ট। প্রসিকিউশনের দুর্বলতা যেমন আদালত ঢাকতে পারেন না, তেমনি আইনি দুর্বলতার ঘাটতি আদালত পূরণ করতে পারেন না। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করাসংক্রান্ত আইনি কাঠামোও দুর্বল ও অস্পষ্ট। সরকারের অঙ্গীকার ও সদিচ্ছার অভাব তাকে আরও প্রকট করে। 

আইয়ুব আমলে কী ঘটেছিল এবং বিচার বিভাগ কী করেছিল, সেটা আমরা দেখব। আজ শুধু আদালত পর্ব।

১৯৬৪ সালের ৬ জানুয়ারি। একই দিনে দুই প্রদেশের স্বরাষ্ট্র বিভাগ পৃথক বিজ্ঞপ্তি জারি করে জামায়াত-ই-ইসলামিকে নিষিদ্ধ করল। তখন ১৯৬২ সালের সংবিধান কার্যকর আছে। তাতে মৌলিক অধিকারের ভাগ আছে। যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সেখানে সংগঠন করার স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা আছে। অথচ দুই প্রাদেশিক সরকার জামায়াত নিষিদ্ধ করতে ১৯০৮ সালের ক্রিমিনাল ল অ্যাক্ট নামের একটি অচল আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করল।

ওই আইনের ১৬ ধারায় বলা ছিল, ‘যদি কোনো সমিতি প্রশাসনিক আইনে হস্তক্ষেপ করে কিংবা হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্যসংবলিত কোনো চেষ্টায় লিপ্ত হয় কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কিংবা জনশান্তির প্রতি বিঘ্ন ঘটায়, তাহলে প্রাদেশিক সরকার সেই ধরনের সমিতিকে বেআইনি ঘোষণা করতে পারে।

ওই ধারায় জামায়াত নিষিদ্ধ হলো। পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক তৎপরতায় লিপ্ত থাকা ছিল মূল অভিযোগ। পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট ও পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দুটি আলাদা রিট হলো। এই মামলায় ১৯৬৪ সালের ১৩ জুলাই বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিলেন। বললেন, সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইনে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আদেশ বেআইনি। অন্যদিকে পাঁচ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট বেঞ্চের রায়ে জামায়াত বেকায়দায় পড়ল। ১৯৬৪ সালের ১৬ জুন তাঁরা বললেন, সরকারের আদেশ বৈধ।

পশ্চিম পাকিস্তানের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদি এবং পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করল সুপ্রিম কোর্টে। মওদুদির পক্ষে এ কে ব্রোহি এবং সরকারের পক্ষে মঞ্জুর কাদের লড়লেন।

পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কর্নেলিয়াসের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ১৯৬৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সরকারি আদেশ অবৈধ বলে ঘোষণা দেন। সর্বসম্মতভাবে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের রায় সমুন্নত রাখেন।

সুপ্রিম কোর্টের দীর্ঘ রায়ে আইনি কূটতর্কই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তবে প্রধান বিচারপতি কর্নেলিয়াসের দেওয়া রায়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি নিতান্তই আইনের ফাঁক চিহ্নিত করে জামায়াত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে বেআইনি ও অসাংবিধানিক ঘোষণা দেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যমন্ডিত অভিযোগগুলোর সত্যতা তিনি নাকচ করেননি। প্রধান বিচারপতির এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের অন্য চার বিচারপতি সহমত পোষণ করেছেন। 

বিচারপতি কর্নেলিয়াসের পুরো নাম আলভিন রবার্ট কর্নেলিয়াস। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। আগ্রার এক উর্দুভাষী খ্রিষ্টান পরিবারে তাঁর জš§। ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ নিয়ে তাঁর রায় ও আইনি দর্শনের জন্য তিনি প্রসিদ্ধ। একাত্তরের মার্চে তিনি ইয়াহিয়া-মুজিব সংলাপে যোগ দিয়েছিলেন।

বিচারপতি কর্নেলিয়াস লেখেন, ‘আমি জামায়াতের বিরুদ্ধে আনা বিবিধ অভিযোগ (এর মধ্যে পাকিস্তাানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি সূত্রগুলোর কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তি অন্যতম) এবং তা খণ্ডন করে জামায়াতের দেওয়া উত্তরের গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করব। আমার মত হচ্ছে, উভয় পক্ষের প্রশ্নোত্তর থেকে উদ্ভূত প্রেক্ষাপটে এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।’ তাঁর সঙ্গে এ মামলার রায়দানকারী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস এ রহমান, বিচারপতি ফজলে আকবর, বিচারপতি বি জেড কাইকাস এবং বিচারপতি হামিদুর রহমানও এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন।

প্রধান বিচারপতি এখানেই থামেননি। তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘এই সম্ভাবনা আমি অস্বীকার করি না, সে ধরনের তদন্তে প্রাদেশিক সরকারগুলোর নেওয়া পদক্ষেপ যুক্তিসংগতভাবে সমর্থিত হতে পারে। এমনকি যে ১৬ ধারার আওতায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা-ও সমর্থিত হতে পারে।’

প্রচলিত আইনমতে, সুপ্রিম কোর্টের এ রায়ের নির্দেশনার আইনি মূল্য স্বাধীন বাংলাদেশের সামনে আজও টিকে আছে। এর ভিত্তিতে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ নেওয়ার দরজা খোলা। কেবলই যুদ্ধাপরাধ নয়, আমাদের কাছে জামায়াতের স্বাধীন বাংলাদেশ বিরোধিতার তথ্যও আছে। আর যুদ্ধাপরাধী বা ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে একেবারেই বিবেচনায় না নিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে সে জন্য সরকারকে মেঠো বক্তৃতা ত্যাগ করতে হবে।

ন্যায় ও নিরপেক্ষতাকে আহত করে, এমন যেকোনো ‘চেতনা’ পরিহার করে একটি তদন্ত কমিশন করতে হবে। তাঁরা দেখবেন, পুলিশ কী পরিস্থিতিতে তথাকথিত গণহত্যা চালিয়েছিল। সেই তদন্ত কমিশনের গ্রহণযোগ্য প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাকিস্তান ছাড়াও ভারতেও জামায়াত নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু আদালতে তা টেকেনি। সিদ্ধান্ত না টেকাতে পারলে রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক শক্তির আফসোসের কোনো সীমা থাকবে না।

 

৪১ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর জামিন মঞ্জুর - dainik shiksha ৪১ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর জামিন মঞ্জুর শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতিপক্ষ নয়: কাদের - dainik shiksha শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতিপক্ষ নয়: কাদের সায়েন্সল্যাবে শিক্ষার্থীদের গণমিছিল - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে শিক্ষার্থীদের গণমিছিল শাহবাগে দুঃস্থদের মাঝে ছাত্রলীগের খাবার বিতরণ - dainik shiksha শাহবাগে দুঃস্থদের মাঝে ছাত্রলীগের খাবার বিতরণ ছাত্র ইউনিয়নের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা - dainik shiksha ছাত্র ইউনিয়নের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা বরিশালে শিক্ষার্থীদের গণমিছিল, মহাসড়কে বিক্ষোভ - dainik shiksha বরিশালে শিক্ষার্থীদের গণমিছিল, মহাসড়কে বিক্ষোভ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034248828887939