অপারেশন জ্যাকপট। হিরণ পয়েন্টে ক্যাপ্টেন নৌ-কমান্ডো হুমায়ুন কবীর। বাড়ি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে কিছুদিন ইস্ট পাকিস্তান পুলিশে কর্মরত ছিলেন। নৌ-কমান্ডে যোগ দেয়ার আগে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রথম প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেন। অপারেশন জ্যাকপটের ছয় পয়েন্টের একটিতে ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। নৌ-কমান্ডো অভিযানের আদ্যোপান্ত নিয়ে ঢাকার মিরপুরের ১০ নম্বরের এক রেস্তোরাঁয় বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন লেখক, গবেষক ও সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন আপনি ঠিক কোথায় অবস্থান করছিলেন, কোনো কাজে যুক্ত ছিলেন কি?
হুমায়ুন কবীর: তখন আমি খুলনায় ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, ১৯৭০ এর দিকে ইস্ট পাকিস্তান পুলিশে যোগ দিয়েছিলাম। সারদায় ছয় মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজারবাগে আসি। সে সময় সারাদেশে হরতাল, মিছিল-মিটিং, কারফিউ চলছে। এই অবস্থায় আমার বাবা খুলনা থেকে রাজারবাগ এসে মেডিক্যাল ছুটি করিয়ে আমাকে নিয়ে যায় (একাত্তরে যুদ্ধে শহীদ হন)। ছুটি শেষ হলে আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়, তবু তিনি, আমি আর পুলিশে যোগ দিইনি।
২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের খবর আমরা খুলনা বসে পাই। আমরা তখন খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের ভেতরে। আমার বাবা-চাচা তখন ওখানে চাকরি করতেন। বাসা ছিল মিলের ভিতর কলোনিতে। মিলের সামনে মূল রাস্তা, দক্ষিণ পাশে বিহারি কলোনি। এই বিহারিরা পাকিস্তানিদের ইন্ধনে, সাহসে স্থানীয়দের উপর অত্যাচার শুরু করে। বেশকিছু বাঙালি হত্যা করে। আমরা তখন তাদের প্রতিরোধ করি। এ অবস্থায় ২৫ মার্চের গণহত্যার খবরে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ভাবতে থাকি, কী করবো।
তখন আপনার বয়স কত?
হুমায়ুন কবীর : প্রকৃত বয়স তখন ১৫ বছর। তবে সবাইকে বয়স বাড়িয়ে বলতাম। যাতে সবাই গুরুত্ব দেয়। গুরুদায়িত্ব পাওয়া যায়।
২৫ মার্চের গণহত্যার খবরে আপনারা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। কোনো প্রতিরোধের কথা ভাবলেন কি?
হুমায়ুন কবীর : হ্যাঁ। নিউজপ্রিন্ট মিলের মেরিন ডিপার্টমেন্টের আলম সাহেব এবং আমার বাবা আব্দুল মজিদ শেখ দুজনে মিলে খোঁজ করছিলেন কারা বন্দুক বা রাইফেল চালাতে পারে। কারণ, এই সময় খবর আসে, পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খুলনা এসে আক্রমণ করবে। তারই গণ প্রতিরোধের প্রস্তুতি হিসেবে এই সন্ধান। তখন আমার বাবা বললো, আমার কথা যে, হুমায়ুন তো বন্দুক চালাতে পারে। ওর ট্রেনিং আছে। তখন তাঁরা দুজন মিলে আমার সাথে বসলেন। আমার সাথে তখন আমার এক বন্ধু ও আমার আপন বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম ছিলো। এ পরিস্থিতিতে মিলের ভেতরে শ্রমিক-কর্মকর্তা, ছাত্র-সাধারণ মানুষ সব এক হয়ে গেল। তখন আমরা অস্ত্রের সন্ধান করলাম। সিদ্ধান্ত নিয়ে মিলের ভেতরে থাকা ‘অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প’ লুট করে অস্ত্র নিয়ে এলাম। মোট সাতটি থ্রি নট থি রাইফেল পেলাম।
কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই এটা সম্ভব হলো?
হুমায়ুন কবীর : পুলিশ ক্যাম্পের সবাই ছিলো বাঙালি। তারা কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই অস্ত্রগুলো দিয়ে চলে গেল।
আপনাদের সঙ্গে তাঁরা যোগ দিল না?
হুমায়ুন কবীর : না। পাকিস্তানিরা মেরে ফেলতে পারে এই ভয়ে তারা চলে যায়।
তারপর কী করলেন?
হুমায়ুন কবীর : তখন আমরা ঐসব অস্ত্র ও মিলের ভেতরে যাদের ব্যক্তিগত বন্দুক ছিল সব একসাথে জড়ো করলাম। তারপর অস্ত্রসহ লোকজনকে তিনটি দলে ভাগ করে, মিলের তিনদিকে পজিশন নিই। পজিশন নিয়ে ২৬ মার্চ দিনগত রাতে টহল দিই। পরদিন ২৭ মার্চ সকাল ৭টায় পাকিস্তানিরা বড় ট্রাকে করে যখন মিলের সামনের রাস্তা দিয়ে যায়, তখন আমি সবার আগে ফায়ার করি। তখন আমাদের তিনটি দলই ফায়ার করে। এসময় পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করতে করতে বিহারি কলোনির ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর বিহারিরাও নিজেদের অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানিদের সাথে যোগ দেয়। তারা একযোগে গুলি ছুঁড়তে থাকে, আমরাও গুলি করি। তবে আমরা ধীরে ধীরে গুলি করি, কারণ আমাদের হাতে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ছিল না। আমরা চাইছিলামই, এই সুযোগে মিলের কলোনিতে থাকা মানুষজন সবাই নিরাপদে সরে পড়ুক। এভাবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এরই মধ্যে খবর পেয়ে যশোর থেকে ভারী অস্ত্র-গোলাবারুদসহ আট থেকে দশ গাড়ি পাকিস্তানি আর্মি পুরো মিলটিকে ঘিরে ফেলে। তারপর কলোনিতে ঢুকেই প্রথমে মিলের মেরিন ডিপার্টমেন্টের আলম সাহেবের সাথে আরও দুজনকে তারা হত্যা করে। আমার কাছে তখন মাত্র তিনটি কার্টিজ। আমার বড়ভাই ও পিতা এক দৌড় দিয়ে হাসপাতালে ঢুকে বেডে শুয়ে পড়ে। আমার অন্য কোনো সুযোগ না থাকায় পাশেই রূপসা নদীর ঘাটে চলে যাই। জেটির নিচে রাইফেল রেখে সাঁতরে রূপসা নদীর ওপারে চন্দনীমহল এলাকায় চলে যাই। চন্দনীমহলে তখন কোনো মানুষজন নেই। পাকিস্তানিদের ভয়ে ঘর-বাড়ি রেখে সবাই পলিয়েছে। আমি তখন বাবা ও বড়ভাইয়ের অপেক্ষায় আছি। ঘণ্টা দেড়েক পর পাকিস্তানি আর্মি চলে যায়। শুনতে পাই মিলের ম্যানেজার ইকরামুল আমীন পাকিস্তানি আর্মিকে বলেছে- যারা গণ্ডগোল করেছে তারা সব নদীর ওপার থেকে এসেছিল, তারা আবার নদী পার হয়ে চলে গেছে। এখন যারা আছে তারা আমার মিলের লোক। কিছুক্ষণ পর দেখি বড়ভাই নদী পার হয়ে আমার দিকে আসছে। আমিও দৌড়ে যাই। দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরি। এরপর আমরা বাসায় ফিরে আসি।
ভারতে গেলেন কবে?
হুমায়ুন কবীর : এপ্রিলের শেষদিকে ভারতে যাই। তারিখ ঠিক স্মরণে নেই। তিনদিনে প্রায় ৮০ মাইল রাস্তা হেঁটে পার হয়েছি।
এরমধ্যে কোনো সমস্যা হয়নি?
হুমায়ুন কবীর : যাত্রা পথের একটা ঘটনা বলা দরকার। আমরা বর্ডারের কাছাকাছি যখন পৌঁছি। ঠিক কাছাকাছি নয়, প্রায় দশ মাইল দূরে আছি। তখন আমাদের তীব্র ক্ষুদা লাগে, পিপাসা পায়। আমার দলে তখন ১১ জন। তারা সবাই আমার এলাকারই। আমিই ওদের নিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার পাশে থাকা এক দোকান থেকে সবার জন্য চিড়া কিনলাম। চিড়া চিবাতে চিবাতে আমরা হেঁটে যাচ্ছি আর পানির সন্ধান করছি। কিন্তু কোথাও পানি পাচ্ছি না। একসময় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়ার পথে একটা পুকুর চোখে পড়লো। আমরা মহা আনন্দে দৌঁড়ে গেলাম পানি খেতে। দেখি পুকুরে মানুষের রক্তাক্ত লাশ ভাসছে। তবু আমরা বাধ্য হয়ে ওই পানিই পান করি। এভাবে নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বনগাঁ দিয়ে আমরা ভারতে পৌঁছাই। আমরা গেলাম বনগাঁ পাঁচ নম্বর টালিখোলা ক্যাম্পে। এর একদিন পরেই আমাকে রিক্রুট করা হয় নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণের জন্য।
ভাগীরথী নদীর তীরে স্থাপিত সেই ক্যাম্পের দিনগুলো কেমন ছিল?
হুমায়ুন কবীর : ওখানে গিয়ে আমাকে বন্ড সই দিতে হলো। অর্থাৎ আমি যদি যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যাই তাতে কেউ দায়ি থাকবে না। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলে আমার। দিন কয়েকের মধ্যেই পুরোদমে প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ হতো। ওখানে খুব কড়াকড়ি ছিল। যেন কেউ কিছু জানতে না পারে। আমাদের রেশন আসতো হেলিকপ্টারে করে। ৯০ দিন ট্রেনিং করলাম সেখানে। এই সময়ে চন্দ্র-সূর্য ছাড়া অন্য কিছু দেখার সুযোগ হয়নি।
ভাগীরথী নদীতে আমরা ট্রেনিং দিয়েছি। মূল প্রশিক্ষণটা নদীতেই হয়েছে। শুধু একটা নেংটি পরে সাঁতার প্রশিক্ষণ দিয়েছি। একসময় পেটে গামছা দিয়ে প্রথমে একটি ও পরে দুটো করে ইট বেঁধে সাঁতার কেটেছি। নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণে আমি প্রথম ব্যাচের ছিলাম।
পাকিস্তানিদের পক্ষ ত্যাগ করে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা সাব মেরিনারদের সাথে আপনার দেখা হয়েছিল?
হুমায়ুন কবীর : হ্যাঁ। প্রথম দেখা হয় লে. গাজী মো. রহমতউল্লাহ দাদুর সঙ্গে। তিনিই আমাকে রিক্রুট করেছিলেন।
তাঁকে দাদু বলছেন কেন, তিনি আপনার আত্মীয়?
হুমায়ুন কবীর : না। নির্দেশনা অনুয়ায়ী গোপনীয়তা রক্ষার জন্য তাঁকে স্যার না বলে দাদু বলতাম।
ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর কী করলেন?
হুমায়ুন কবীর : ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর আমাকে অপারেশন জ্যাকপটের ক্যাপ্টেন করে হিরণ পয়েন্টের দায়িত্ব দিয়ে পাঠায়। আমিসহ বারো জনের দল। সঙ্গে একজন গাইড। সে নৌকার মাঝি। হিরণপয়েন্ট এলাকার নদী-জঙ্গল ওর পরিচিত। তার আগে হঠাৎ ছয়জন দলনেতাকে ডাকা হলো (অপারেশন জ্যাকপটের ৬টি পয়েন্টের ৬ জন ক্যাপ্টেন)। গাজী মো. রহমতউল্লাহ দাদু ও ভারতীয় নৌ-বাহিনীর লে. ক. মার্টিস আমাদের একত্রে দাঁড় করিয়ে বললো- তোমাদের একটি প্রশিক্ষণে যেতে হবে। এরই মধ্যে একটি হেলিকপ্টার এলে, তাতে আমাদের ৬ জনকে তুলে দেয়া হয়। হেলিকপ্টার আমাদের দিল্লি নিয়ে যায়। একটি মাঠে কপ্টারটি ল্যান্ড করলো। সেটা ভারতীয় আর্মির ক্যাম্প। সেখানে একজন কর্নেল ও সিভিল অফিসার আমাদের অপারেশন জ্যাকপটের সাংকেতিক গানের প্রশিক্ষণ দিল। কোন গান বাজলে আমরা প্রস্ততি নেবো, কোন গান বাজলে হামলা করবো।
প্রথম গানটি ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া- ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’। এই গানটি শোনার পর মনে করতে হবে নির্দিষ্ট টার্গেটের আশপাশে অবস্থান নেওয়ার সময় হয়েছে। গানটি প্রচার হবে কলিকাতা রেডিও সেন্টার-খ (যুববাণী) থেকে। সকাল সাতটা থেকে সাতটা ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বাজলে মনে করতে হবে এটি আমাদের জন্য নির্দেশনা। অন্য সময় বাজলে আমাদের জন্য নয়। পরের গানটি হলো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর (পড়ুন আরতি মুখোপাধ্যায়) গান- ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’। এই গানটি বাজলে মনে করতে হবে, ওই দিনই রাত দুইটার মধ্যে আমাদের টার্গেট ধ্বংস করে দিতে হবে। বাঁচি আর মরি।
তারপর সেখান থেকে হিরণপয়েন্টর দিকে যাত্রা করলেন?
হুমায়ুন কবীর : না। ভারত ছেড়ে হিরণপয়েন্টের দিকে রওনা হওয়ার আগের দিনে রাতে বাকুন্দিয়া ক্যাম্পে একরাত থাকতে হয়। ওই রাতে হঠাৎই মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও শেখ নাসের আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তখন কঠোর নিরাপত্তাজনিত কারণে আমাদের সাথে কারো দেখা করার সুযোগ কিংবা নিয়ম ছিল না। সঙ্গত কারণেই নিরাপত্তারক্ষী তাঁকে তাঁবুতে ঢুকতে দেয়নি। রক্ষী অবশ্য তাঁদের চিনতেও পারেনি। তখন তাজউদ্দিন আহমদ একটি স্লিপ লিখে তাকে দিয়ে আমার কাছে পাঠান। আমি নাম দেখে এক দৌঁড়ে তাঁর কাছে যাই। তিনি আমার হাত ধরে জোরে টান দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন- আই লাইক দিস, আমার পছন্দ হয়েছে। আমার বিশ্বাস আপনারা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েই ফিরবেন। এই অবস্থায় তিনি তাঁবুর ভেতর ঘাসের মধ্যেই বসে পড়েন। তারপর নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। এক পর্যায়ে তিনি আমার হাতে ৫০০ টাকার একটি নোট দিতে চাইলেন। এবং বললেন, আপনার ছেলেদের কিছু কিনে খাওয়ান। আমাদের নিয়ম না থাকায় টাকা হাতে নিইনি। সেটাও তাঁকে খুলে বললাম। তাতে তিনি খুশি হয়ে আরও কিছু টাকা যুক্ত করে নিজ হাতে পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। সবমিলে তিনি প্রায় ১৫-২০ মিনিট তাঁবুতে আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
আপনারা প্রথম হামলা করলেন কত তারিখ?
হুমায়ুন কবীর : ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে আমরা হামলা করি। কিন্তু আমাদের টার্গেট করা জাহাজ মোংলা চলে যাওয়ায় আমরা অন্য দুটো জাহাজ ধ্বংস করি। দুটো জাহাজে তিনটি করে মোট ৬টি মাইন লাগিয়ে সাঁতরে নিরাপদে জঙ্গলে ঢুকে পড়ি। মাইন লাগানোর ৪৫ মিনিট পর জাহাজ দুটি ধ্বংস হয়।
আপনার দলে সদস্যদের নাম?
হুমায়ুন কবীর : ডা. মাহফুজ, নুরুল হক, নুরুল ইসলাম, শমসের আলী, সামছুল আলম, মো. জালাল উদ্দিন। অন্যদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
জাহাজ দুটির নাম মনে আছে কি?
হুমায়ুন কবীর : না। তখন আমাদের এতো কিছু খেয়াল ছিল না। বুঝতামও না। ধ্বংস করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
বলা হয়ে থাকে, নৌ-কমান্ডোরাই তাঁদের মরণপন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ত্বরান্বিত করেছেন?
হুমায়ুন কবীর : এটাই সত্য। শুরুর দিকে পাকিস্তানিরা পোর্ট এলাকায় সৈন্য রাখেনি। সব সৈন্য রেখেছিল গ্রাম-গঞ্জে, শহরে-বাজারে, থানায় থানায়। কিন্তু অপারেশন জ্যাকপটে অনেকগুলি জাহাজ ধ্বংসের পর পাকিস্তানিরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে পাকিস্তানি জেনারেল এ কে নিয়াজি নড়েচড়ে বসে। তারা ধারণা করলো, এই হামলা ভারতীয়রা করেছে। এটা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা সম্ভব নয়। অথচ এই হামলা আমরা বাঙালিরাই করেছি। পরে তারা সিদ্ধান্ত পাল্টে পোর্টগুলোতে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে। তখন আবার দেশের স্থলভাগ অনেকটা ফাঁকা হয়ে পড়ে। এই সুযোগ কাজে লাগায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযুদ্ধে নদীর ভূমিকা আপনি কীভাবে দেখেন?
হুমায়ুন কবীর : নদী পথে আমরা আক্রমণ না করলে ওদের শক্তিক্ষয় হতো না। তারা যুদ্ধ স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তনও আনতো না। এই পরিবর্তনেই আমরা জয়ের সূর্য দেখলাম। সঙ্গত কারণেই নদীর অনেক ভূমিকা রয়েছে। আমাদের কাছে নদী পরিচিত ছিল। কিন্তু ওদের কাছে তা ছিল না। তারা নদী-পানি-জঙ্গল ভয় পেতো। কিন্তু আমরা পেতাম না। ওদের উপর হামলা করে সাঁতরে নদী পার হয়ে ঢুকে পড়েছি সুন্দরবনের ভেতরে। আমাদের পরনে তখন লেংটি আর পায়ে ফিন্স পরা। জঙ্গলে বাঘ, নদীতে সাপ-কুমির ছিল। আমরা ভয় পাইনি। অপারেশন করে সফল হয়েছি। কিন্তু এসবে ওদের ভয় ছিল।
লেখক : ফয়সাল আহমেদ, সম্পাদক, বই বিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘এবং বই’