জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘বন্ধু’ - দৈনিকশিক্ষা

জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘বন্ধু’

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ |

প্রতিটি মানুষের জন্যই প্রয়োজন অন্তত একজন ভালো বন্ধু। যার কাছে মনের সব কথা বলা যায় নির্দ্বিধায়। যার সঙ্গে সব সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়া যায়। সুখের দিনে সেই তো পাশে থাকে, আবার দুঃখেও থাকে ছায়ার মতো। একজন ভালো বন্ধু আসলে মানুষের অদৃশ্য বিবেকের মতো। কারণ সে ভালো কাজে উৎসাহ দেয় আর খারাপ কাজে নিরুৎসাহিত করে সবসময়। বিশ্ব বন্ধু দিবসে সব বন্ধুদের শুভেচ্ছা।

বলা হয়ে থাকে ‘বন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ’। আর সেই শ্রেষ্ঠ সম্পদের গুরুত্ব ও মর্ম উপলব্ধির জন্যই পৃথিবীব্যাপী পালিত হয় বন্ধু দিবস। এর শুরুটা ছিলো ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে। সেই বছর প্রথম বন্ধু দিবসের প্রচলন করেন ‘হলমার্ক কার্ডস’-এর প্রতিষ্ঠাতা জয়েস হল। পরবর্তীতে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকান সরকার আগস্টের প্রথম শনিবার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। প্রতিবাদে ও শোকে পরের দিন ওই ব্যক্তির এক কাছের বন্ধু আত্মহত্যা করেন।

এরপরই বন্ধুদের ভালোবাসার প্রতি সম্মান জানানোর জন্য আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে আগস্টের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর থেকেই প্রতি বছর আগস্টের প্রথম রোববার বিশ্বব্যাপী ‘বন্ধু দিবস’ বা ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’ পালিত হয়। বন্ধু দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানা যায়, প্রাচীনকালে মানুষের জীবনযাত্রা ছিলো খুবই কঠিন। ক্রমান্বয়ে মানুষ আবিষ্কার করে আগুন, চাকা, নানা ধরনের অস্ত্রসহ আরো কত কিছু...। খাবারের জন্য পশু শিকার করতে হয়েছে। আবার হিংস্র পশুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে যুদ্ধও করতে হয়েছে। এতোসব বিপদের মাঝে তারা একটা জিনিস খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে যে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে, ভালোভাবে বাঁচতে হলে একসঙ্গে থাকতে হবে। তাই তারা নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। তাদের মধ্যে ভাবের বিনিময় হয়।

একে অপরের প্রয়োজনে, বিপদে আপদে, দুঃখে কষ্টে যেমন এগিয়ে আসতে শুরু করে তেমনি আনন্দটাও একসঙ্গে উপভোগ করতে থাকে। আর তখনই সবার মাঝে গড়ে ওঠে একটা সম্পর্ক। যে সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব। প্রথমদিকে, আমেরিকাতেই শুধু উদযাপিত হত বন্ধুত্ব দিবস। আস্তে আস্তে অন্য দেশগুলোতে, এরপর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বন্ধু দিবসের ধারণা। সেই স্রোত এসেছে আমাদের দেশেও। আমাদের দেশেও এখন সমান্তরালে প্রতিবছরই পালন করা হয় এই দিবস। জাতিসংঘ ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাই দিনটি আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস ঘোষণা করে। সুতরাং ৩০ জুলাইকেই আন্তর্জাতিক ভাবে বন্ধু দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

আরো জানা যায়, ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কার্ড, ফুল, উপহার বিনিময় করতো। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে জয়েস হলের প্রতিষ্ঠিত হলমার্ক কার্ড বন্ধু দিবস উদযাপনের রীতিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছিলো। কথিত আছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বিশৃঙ্খলা ও হিংস্রতা মানুষের মধ্যে অনেকটাই বন্ধুত্বের অভাব তৈরি করেছিলো। ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধু দিবস উদযাপন করার ধারণা এসেছিলো বলে অনেকে মনে করেন।

কথায় বলে বিদেশি ভাষার বুলি, দেশি ভাষায় গালি। বাংলাভাষায় বন্ধু শব্দের কিছু বিদেশি প্রতিশব্দ রয়েছে। বাঙালি জাতি বৈচিত্রপ্রেমী। ভাষাগত এই বৈচিত্রও হয়তো কারো কারো কাছে আকষর্ণীয় হয়ে উঠতে পারে। 
‘বন্ধু’ শব্দটিকে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিবিধভাবে বলা সম্বোধন করা হয়। যেমন আলবেনিয়া- মিল্ক, আফ্রিকা- ভ্রেন্ড, চীন-পেনজিউ, ডাচ- ভ্রেন্ড, ভ্রেঞ্জ, ডেনিশ- ভেন, ফ্রে-আমি, জার্মানী ফ্রিউন্ড, জর্জিয়ান-মেগোবারি, হাংগেরিয়ান–বারাট, হিন্দি-দোস, ইটালিয়ান-আমিকো, আইরিশ-কারা, জাপানি-টমোডাচি, কোরিয়ান-জিঙ্গু, ল্যাটিন-আ্যামিকাস, রাশিয়ান-প্রিজাটেল, সংস্কৃত-মিত্রা, স্পেনিশ –অ্যামিগো।

বন্ধু ভিন্ন এক সত্তার নাম। একজনের হৃদয় পুড়ে গেলে যদি অন্যজনের হৃদয়ে পোড়া গন্ধ না উঠে, একজনের আনন্দে যদি অন্যজনের চিত্ত প্রফুল্ল না হয়, তবে তারা বন্ধু নয়। বন্ধুর জন্যে হৃদয় তোলপাড় করা প্রেম চাই। যে প্রেমের কাছে আর সব বিত্ত–বৈভবের হাতছানি তুচ্ছ। যে প্রেমে দুটি দেহে একটি আত্মা বিরাজ করবে অবিরাম।

বন্ধু কিংবা বন্ধুত্বের মতো সম্পর্কের সঙ্গে মানুষের পরিচয় যুগ-যুগান্তরের। একজন ভালো বন্ধুর অভাব মানুষকে যতটা পোড়ায়, পৃথিবীর আর কোনো অভাব এতোটা পোড়াতে পারে না। বন্ধুর কাছে নির্দ্বিধায় অকপটে বলা যায় সবকিছু, ভালো কিংবা মন্দ। চলার পথে আমাদের অনেকের সঙ্গেই পরিচয় ঘটে; সময় কাটে, শেয়ারিং হয়, কেয়ারিং হয়। কিন্তু তারা সবাই বন্ধু নয়।

১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ বিশ্বময় বন্ধুত্বের আলাদা অবস্থানে নিজেদের নিয়ে যায়। সে বছরটিতে জাতিসংঘ বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র উইনি দ্যা পুহকে বন্ধুত্বের বিশ্বদূত হিসেবে নির্বাচিত করে। বন্ধু দিবসের এই বিশ্বদূত ছাড়াও বন্ধুত্ব দিবসের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে হলুদ গোলাপ আর ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডের মতো বিষয়গুলোও। মজার বিষয় হলো, এই ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডের ধারণাটিও এসেছে আমেরিকা থেকেই। আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই বন্ধুত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্যান্ড দেয়ার এই রীতি চালু আছে। তারা তাদের বন্ধুদের জন্য ব্যান্ড তৈরি করে। আর যাকে ব্যান্ড দেয়া হয়, সেও কখনোই ব্যান্ডটি খোলে না।

বন্ধুত্বের প্রতীক যে হলুদ গোলাপ সেই হলুদ রং হলো আনন্দের প্রতীক। হলুদ গোলাপ মানে শুধু আনন্দই নয়, প্রতিশ্রুতিও। কাজেই বন্ধুত্বের মাঝে যেনো আনন্দের পাশাপাশি থাকে প্রতিশ্রুতি সেই কথাটিই যেন মনে করিয়ে দেয় এই বন্ধু দিবস।

বর্তমান সময়ে পুরো পৃথিবীটাই একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে গোটা বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। আর তাই বন্ধুত্ব ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে। আসলে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা এমন যে, সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন। বন্ধুত্ব সম্পর্ককে সহজ করে। বলে-কয়ে বন্ধুত্ব হয় না। মনের সঙ্গে মনের মিল হলেই শুধু সত্যিকারের বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্বে অহংকার ও হিংসার স্থান নেই। ‘বন্ধুত্ব’ এমন একটা বিষয়, যা অনেক ক্ষেত্রে জীবনের চেয়েও দামি হয়ে দাঁড়ায়। এমন নজির পৃথিবীতে বহু আছে।

ব্যস্ততার জন্য এখন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করা যায় না। তবে তাই বলে বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা কিন্তু কমে যায় না। বন্ধুতো একদিনের জন্য নয়। বন্ধু হচ্ছে সারা জীবনের পথ চলার অনুপ্রেরণা। শুধু বড় বড় দেশগুলোও নয়, আমাদের দেশেও পালিত হয় বন্ধুত্ব দিবস। তবে এখনো সীমিত আকারেই রয়েছেই এটি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এসএমএস আদান প্রদান, কার্ড আদান প্রদান, বই বা অন্য কোনো উপহার বিনিময় করতে দেখা যায়।

রাজধানী ঢাকার বেশ কিছু রেস্তোরাঁ এ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করে থাকে। আবার কিছু বিপণিবিতানে বিভিন্ন পণ্যের উপর বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। মূলত তরুণদের মধ্যেই এই সংস্কৃতির লালন বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের ছোট বড় সব শহরের তরুণরা এদিনে তাদের বন্ধুদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে। প্রতিটা মানুষের জীবন রহস্যময়। জীবন জুড়ে থাকে কতোই না অদ্ভুত কাণ্ড। আজকের দিনটা আগামী দিনের স্মৃতি। আর এই স্মৃতি হলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত। স্মরণীয় মুহূর্তের অন্যতম অধ্যায় হলো বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সময়। বন্ধু কথাটি একটি শব্দ কিন্তু গভীরতা ও ভার অসীম। পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে যে কয়টি সম্পর্ক রয়েছে তার মধ্যে বন্ধুত্ব সম্পর্ক সব থেকে কাছের। বলা হয়ে থাকে মানুষের মধ্যে স্বার্থ ছাড়া যদি কোনো সম্পর্ক থাকে তাহলে সেটা হলো বন্ধুত্ব। 

একজন বিখ্যাত মনীষী বলেছিলেন, ‘আত্মীয়-স্বজন জন্মসূত্রেই পাওয়া যায়, কিন্তু বন্ধু বেছে নেয়ার সুযোগ আছে, এজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’ সত্যিই কোনোরকম রক্ত সম্পর্কের না থাকা সত্ত্বেও একজন মানুষ আরেকজন মানুষের এতো আপন হতে পারে এবং নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে সেটা একজন সত্যিকার বন্ধুর মাধ্যমেই উপলদ্ধি করা যায়। তাই একজন ভালো বন্ধু পাওয়া এবং কারো ভালো বন্ধু হওয়া মানে অনেক বড় অর্জন। আমাদের সকলের মাঝে যেনো বন্ধুত্ব চির সবুজ এবং সতেজ থাকুক সারা বেলা, সারা জীবন। 

লেখক: সাংবাদিক

মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033559799194336