কথায় কথায় আমরা বলি প্রাথমিক শিক্ষাটা হচ্ছে শিশুদের জন্য সবচেয়ে প্রধান জায়গা। শিশুর ভবিষ্যৎ আর রাষ্ট্রকাঠামোর রাজনৈতিক চিন্তার ভিত্তিটাও গড়ে উঠতে থাকে ওই শিশুকাল থেকেই। পরিবার ও প্রতিবেশের পর বিদ্যালয়ই হচ্ছে শিক্ষার প্রধান উপকরণ। সেই উপকরণের অবস্থা কেমন এ প্রশ্ন আমরা করতে পারি। কারণ শিক্ষার প্রাথমিক ভিতটা সেখানে পোতা আছে। শনিবার (৩ ডিসেম্বর) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায, আমাদের ৮৫ হাজার গ্রামের প্রত্যেকটিতে কি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে? প্রত্যেক গ্রামে প্রাইমারি স্কুল নেই, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আবার আরেকটা প্রশ্ন হচ্ছে সেসব স্কুলের অবকাঠামো, মানে স্কুল ঘর, বেঞ্চ, ব্ল্যাকবোর্ড এবং শিক্ষক আছে কি নেই, সেটাও বড় বিষয়। অবকাঠামো না থাকলে বা থাকলেও সেই স্কুলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক আছে কি নেই, সেই বিবেচনাও করতে হবে। শিক্ষক থাকলেও তাদের শিক্ষা দানের দক্ষতা বা যোগ্যতা কতটুকু সেটাও অনুধাবন করতে হবে। শিশুর মানসিক ও তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে সেসব শিক্ষকের জ্ঞান-গরিমা কতটা, তাদের শিক্ষাবিষয়ক প্রশিক্ষণ আছে কি নেই, শিক্ষকের মানবিক ও নৈতিক মানসিকতার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সব কিছুর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কারিকুলাম, পাঠসূচিতে কী কী অন্তর্ভুক্ত রাখা হবে বা হয়েছে, সেটাও শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিশু যদি দেশ ও জাতির সাংস্কৃতিক স্পর্শে বেড়ে উঠতে না পারে, তাহলে সে বা তারা হয়ে পড়বে শেকড়চ্যুত মানুষ। আমরা সেটা হতে দিতে পারি না। রাজনৈতিক স্বার্থ বা দলীয় স্বার্থ পরিহার করে শিক্ষাকে সার্বজনীন করার দায়িত্ব পালন করতে হয় সরকারকে। এ নিয়ে আমাদের সমাজ শঙ্কিত বলেই প্রশ্নগুলো ওঠে আসছে। নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান চর্চার সঙ্গে আমাদের আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর তথ্য-জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে তারা দেশ ও জাতির ভেতরের প্রজ্ঞাময় জীবনযাপনের বিষয়ে জানতে ও বুঝতে পারে। এ সব দায়িত্ব তারা ভেবে দেখেছেন কি না, তা সমীক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের। আমরা কেবল প্রশ্ন তুলে ধরতে পারি। জিজ্ঞেস করতে পারি, দায়িত্বটা তারা পালন করেছেন কি না।
দুই.
৪৬০ স্কুলে নেই প্রধান শিক্ষক, সরাইল ও টাঙ্গাইলে প্রাথমিক শিক্ষা বেহাল কেন?- এই শিরোনামের নিচে প্রতিবেদনটি ছেপেছে প্রথম আলো, ২৫ নভেম্বর, ২২-এ।
সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কী হাল এই রিপোর্ট থেকেই তা অনুমান করা যায়। এর জবাবে নিশ্চয় শিক্ষামন্ত্রী বলবেন, আমাদের শিক্ষা সংস্কার চলছে। এর পরই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আসলে তা কোনো দিনই ঠিক হবে না। কারণ ঠিক করার যে মানসিকতা তা সরকারের নেই। তারা তো প্রত্যেক নাগরিকের যে সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে সে ব্যাপারেই উদাসীন। না হলে দেশের সব গ্রামের শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনতে ৫০ বছর লাগে না। মাত্র ১০ বছরের একটি পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে যে পরিমাণ অর্থ লাগবে ১০টি বাজেটের ভেতর দিয়েই তা কার্যকর করা যায়, যদি সদিচ্ছা থাকে। সদিচ্ছা থাকলে কী করা যায়, তা তো আমরা যমুনা ও পদ্মা সেতু নির্মাণ করেই দেখিয়েছি। এ রকম আরো অনেক প্রকল্পই অগ্রাধিকার তালিকা করে বাস্তবায়ন হচ্ছে। সরকার সেই দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বেশি। শিক্ষার ক্ষেত্রে উদাসীনতার নমুনা সর্বত্রই বিরাজমান। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বেলায় এতটা অনীহাপ্রবণ যে শিশু-কিশোররা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেড়ে মাধ্যমিকে কোথায় পড়বে, তার হদিস পায় না। আবার মাধ্যমিক পাস করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির সুযোগ শিক্ষার্থীর তুলনায় অনেকটাই কম। উচ্চ মাধ্যমিকের পর তারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, সেখানেও প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আসনগুলোর তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি। এ রকম প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্টরা বলবেন, কেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো অনেক আসন আছে, সেখানে ভর্তি হলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
হ্যাঁ, তা যায় বটে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো শিক্ষার দোকানমাত্র। আপনি উচ্চমূল্যে শিক্ষা কিনবেন, তারা শিক্ষা দেবেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়গুলোর মান কতটা ভালো সেটাও দেখার বিষয়। কড়ে আঙুলে গোনা যায়, এমন কয়েকটিতেই মান সন্তোষজনক। বাকিগুলো মধ্যমশ্রেণির ও নিম্নমানের। কিন্তু তার পরও সেগুলো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ যারা নেয়, তাদের বিত্তের কমতি নেই। কিন্তু গ্রামের বা উপজেলা/জেলা শহরের ভালো ছেলেটিও সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না টাকার অভাবে। ফলে অনেক ছেলেমেয়েই হাত গুটিয়ে বসে থাকে পরবর্তী বছরের ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ভর্তির আশায়।
মাধ্যমিক পাস করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হবে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা তো সরকারের হাতে আছে বা থাকেই। সেই পরিমাণ শিক্ষার উপযুক্ত কলেজ কি আছে আমাদের? আবার কী পরিমাণ যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আসবে, সেটাও সরকারের তথ্য ব্যাংকে আছে। তাহলে সরকারি স্তরে তাদের ভর্তি করে নিতে কষ্ট হবে কেন। কেন তারা ভর্তিযুদ্ধ করে ভর্তি হবে? কেন তারা ভর্তি হতে না পারার শঙ্কায় ভুগবে? কেন তারা এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াবে ভর্তির পরীক্ষা দিতে? এই সংকটের সমাধান কোথায় তা কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষামন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টরা রাখেন না?
আমাদের তো মনে হয়, সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নামক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে এমন কাজ করছে, যাতে তারা ব্যবসা করতে পারে। তাতে যে অভিভাবকদের আর্থিক কোমর ভেঙে যায়, সেটা তারা জেনেও না জানার ভান করে থাকেন। আসলে শিক্ষা ক্ষেত্রে এই অনৈতিকতাই আমাদের শিক্ষার ও জ্ঞানচর্চার মেরুদণ্ড ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। তার পরের স্তর হচ্ছে চাকরি জীবন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরি জীবনে কতটা ছেলেমেয়ে ঢুকতে পারছে? আর কতসংখ্যক পড়ে থাকছে বেকার জীবনে, বাবা-মার বোঝা হয়ে। কাজের ক্ষেত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থীর রেজাল্ট ধরে কেন তাদের বাছাই করে তার উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না, তা কি জবাব দেবেন তারা? আমাদের সব থেকে বড় সেক্টর হচ্ছে কৃষির ওপর অবশ্যই জোর দেয়া। কৃষির যতগুলো শাখা আছে, তার জন্য শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত দক্ষ লোকবল সৃষ্টির সঠিক পরিকল্পনা কি আছে? পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনে সরকারের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও, তার কার্যকর প্রয়োগ নেই। সুষম খাদ্যের ঘাটতি পূরণে কৃষি সেক্টরের অবদান সব থেকে বেশি হলেও, ওই সেক্টরটি অবহেলিত। যারা আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদনের আসল কারিগর, সেই কৃষকদের জন্য সরকারের তরফে তেমন কিছু করা হয় না। কৃষকদের কেবল ফসল উৎপাদনের পরামর্শ দিলেই হবে না, তাদের সহায়তা দেয়ারও বিকল্প নেই। গোটা কৃষক সমাজকে কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত করা জরুরি। এটা শিক্ষার প্রধান বিষয়ও।
সরকারের চিন্তা-ভাবনায় কিংবা পরিকল্পনায় জব মার্কেটে কত জব আছে, সেই অনুপাতে উচ্চশিক্ষার ডিজাইন করেছে? সরকারি ও বেসরকারি খাতে জবের সুযোগ অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষিতদের সুযোগ সৃষ্টি করা সরকারের প্রধান কাজ।
৬৫/৬৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না খোলার অনুমতি না দিয়ে ওইসব ব্যবসায়ীকে যদি বলা হতো যার যার এলাকার/উপজেলায় ৫০টি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তৃণমূলের গরিব মানুষের শিশুদের শিক্ষা দিতে পারলে তারা পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় করার পারমিশন পাবেন। না, সরকার সেই পথে হাঁটেনি, হাঁটবেও না। কারণ সরকার ওইসব শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে বলীয়ানের সুযোগ দেয়ার জন্য উদগ্রীব। তারা গ্রামাঞ্চলের শিশুদের জন্য কিছুই করবেন না। করবেন না, তা তো সরাইল আর টাঙ্গাইলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৬০টি স্কুলের প্রধান শিক্ষক না থাকা থেকেই বোঝা যায়। আমরা বুঝি জ্ঞানচর্চার প্রাথমিক স্তরেই যদি এমন অবহেলা থাকে, তাহলে মধ্যম ও উচ্চ মাধ্যমিকের দশা কতটা করুণ। গোটা দেশের প্রাথমিকের দশার সঙ্গে যদি সরাইল ও টাঙ্গাইলের মিল নাও থাকে, তাহলেও এটা বলা যায় যে বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মান তো ওই ছ্যারাবেরা অবস্থারই। তাই ভিত্তিমূলে জ্ঞানচর্চার ভিত্তিটাই নড়বড়ে হয়ে থাকে।
একটা ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়ে শেষ করি এই রচনা। প্রাথমিকে আমি শিখেছিলাম একটি বর্ণ, তার চেহারা এইটা- ‘দঙ’। শিক্ষক আমাকে এবং অন্যদেরও শিখিয়েছিলেন উচ্চারণ- ‘দ উম-অ’। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিখলাম ওই বর্ণের উচ্চারণ ‘দউঅ’। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বনিতত্ত্বের শিক্ষক শিখিয়েছেন এই প্রকৃত উচ্চারণ। ধ্বনিগত এই যে পার্থক্য, তা কয়জনে সঠিক করে নিতে পেরেছেন?
এজন্যই বলি ভিত্তিটা পোক্ত করে গড়ে তুলতে হলে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। আমি মনে করি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমএ পাস করেছেন এমন শিক্ষক নিয়োগ দেন কলেজের বেতন কাঠামো অনুসরণ করে, যাতে তারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারে জাতির মেরুদণ্ড শিশুদের। ওই যে ৪৬০টি স্কুলে প্রধান শিক্ষক নেই, তারা থাকলেও তাদের মান প্রকৃত মানের সমান নয়। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিতদের গ্রামে পাঠান, যাতে তারা জাতি গঠনের উপযুক্ত কাজটি করতে পারেন। কারিকুলাম সংস্কার করে পাঠসূচি পরিবর্তন করে পুস্তক পাঠালেই কেবল হবে না, প্রত্যেক শিক্ষককে প্রশিক্ষিত করতে পারলেই কেবল ফল পাওয়া যাবে। না হলে ডিজিটাল নামের সুদৃশ্য ফলটি মাকালে পরিণত হবে।
লেখক : ড. মাহবুব হাসান, কলাম লেখক ও সাংবাদিক।