ট্রাম্প এবার লক্ষ্য রাখবেন তার পাশের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে যেন কাউকে বারবার না সরাতে হয়। তাই যারা দুর্দিনের ন্যায়-অন্যায়ে সমর্থন দিয়েছেন, ছেড়ে যাননি তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। তার কেবিনেটের অধিকাংশ সদস্য গোঁড়া ধার্মিক। কেবিনেটের অধিকাংশ সদস্যই সাধারণ পরিবার থেকে আসা অপেক্ষাকৃত তরুণ, স্বল্প বা অনভিক্ষ। কারো কারো নৈতিক মান উচ্চ না হলেও তারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, যুদ্ধংদেহি। তাই ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি মতদ্বৈততা করবেন বলে মনে হয় না।
প্রাথমিক লক্ষণে প্রতিভাত হয়, তার আবাসিক এলাকা ফ্লোরিডা থেকেই মার্কো রুবিওকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী করতে যাচ্ছেন। তিনি মূলত অতি সাধারণ, ধার্মিক ক্যাথলিক কিউবান বংশোদ্ভূত উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান। ইহুদিদের প্রতি তার সহানুভূতি থাকবে। তবে বর্তমান সেক্রেটারি অব দ্য স্টেট অ্যান্টনি ব্লিংকেন এর মতো ইজরায়েলের পক্ষে নির্লজ্জভাবে সমর্থন না করলে অন্যান্য ইহুদি সহকর্মীদের চাপে থাকবেন। তিনি কিউবা ও ভেনেজুয়েলার প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাবেন। ভেনেজুয়েলার তেল সম্পদ করায়ত্ত করার ফন্দি ফিকির আঁটবেন। সিআইএ পরিচালক হিসেবে নাম আসা জন র্যাটক্লিফের সঙ্গে সাবেক সিআইএ পরিচালক মাইক পম্পেয়’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার মিল আছে। একদা তিনি বলেছিলেন, ‘We Lied, We Cheated, We Stole’, সিআইয়ের জন্য তিনিই উপযুক্ত। ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্সি আমলে ৭টি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন নিষেধাজ্ঞার গোড়া সমর্থক ছিলেন। মোটামুটি নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় ইরান, প্যালেস্টাইন বিশেষ করে চীনের জন্য ভালো বার্তা দেয় না।
ক্যাথলিক ইলিসে মারি স্টেফানিক জাতিসংঘে আমেরিকার অ্যাম্বাসেডর হচ্ছেন। তিনি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালেস্টাইনী আন্দোলনের বিরুদ্ধপক্ষ অবলম্বন করে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। বয়বৃদ্ধ অভিজ্ঞ সফল প্রশাসক তার কথা মতে বর্ণবাদ বিরোধী ও ইহুদীবাদের ঘোর সমর্থক মাইকেল ডালে জকাবে ইসরাইলে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন। এনারা সকলে মিলে ইসরাইলের স্বার্থে কাজ করবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এখন দেখা যাক, ট্রাম্প এনাদের বাড়াবাড়ির রশি টেনে ধরবেন না আস্কারা দিবেন।
আফগানিস্তানের যুদ্ধ করা, প্রতিরক্ষা পরামর্শক কোম্পানির মালিক মাইকেল ওয়ালটজ ডিফেন্স এডভাইজার হিসাবে অন্য দেশের উপর বন্দুকের নল তাক করতে চাইবেন। ট্রাম্প এমন একজনকে ডিফেন্স সেক্রেটারি করলেন, যিনি চীনের উন্নতি দেখতে চান না। সেক্রেটারি অব দ্য স্টেট এবং গভমেন্ট ইফিশিয়েন্সি ডিপার্টমেন্টের ইউরোপিয়ান-দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এলান মাস্ক ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিবেক রামস্বামী মিলে তাইয়ান অজুহাতে সামরিক-অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে চীনের অগ্রগতি রুখতে চাইবেন। দীর্ঘমেয়াদে চীনের লাগোয়া প্রতিবেশীদের সাথে আরো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ার পরিকল্পনা করবেন। সেই হিসেবে আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি কিছুটা মায়া দেখানো হতে পারে।
রাশিয়াকে কোণঠাসা করার জন্য ইউরোপের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতার ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। রাশিয়া চীনের দোস্তিতে ফাটল ধরাতে পারলে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার সোজা হবে। ইউক্রেন বলির পাঠা না হলেও তাকে মনে কষ্ট নিয়ে দীর্ঘদিন কণ্টকাকীর্ণ পথে হাঁটতে হবে। ইউরোপিয়ান শান্তি সেনা বর্তমান দখলের লাইনের পাশে মোতায়নের চেষ্টা হতে পারে। এতে দু'দিকেই কিছুটা শান্তি হলেও অস্বস্তি থাকবে।
ইউরোপে অনৈক্য, অর্থ এবং বাণিজ্যে আরো বেশি আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা আমেরিকার জন্য সুসংবাদ। ন্যাটোর ক্ষেত্রে ফেলো কড়ি মাখো তেল এই হবে আমেরিকার গোল। ইউরোপের জন্য হেনরি কিসিঞ্জারের উক্তি স্মরণযোগ্য ‘To be enemy of America is dangerous, To be friend of America is fatal.’
এলান মাস্ক ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিবেক রামস্বামীকে গভ:মেন্ট ইফিসিয়েন্সি অফিসে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এদের সঙ্গে ডিফেন্স এডভাইজার কংগ্রেসে ভারতীয় ককাসের মেম্বার মাইকেল ওয়ালটজ যুক্ত হয়ে চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যে বাধার পথ বাতলাবেন। এলান মাস্ক তেসলার বাজার চীনে ধাক্কা খেয়ে ভারতে আরো সম্প্রসারিত করতে চাইবেন। চীনের ইফ আমেরিকার বাজারে বিক্রয় কমানোর জন্য ট্যাক্স বাড়ানোর সংকল্প ট্রাম্পকে আরো বেশি যুদ্ধাংদেহী হতে প্ররোচিত করবেন। এলন মাস্ক ও বিবেক রামস্বামী এই দু’জন ছাড়াও কেবিনেটে ইজরায়েলের সমর্থক সদস্যরা মিলে ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের পক্ষে কাজ করবেন। ভারতকে আমেরিকা অবশ্যই চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইবে। সময় বলে দেবে ভারত আমেরিকার কথায় চীনের বিরুদ্ধে কতদূর নাচে। তারা ভারত কানাডা কাদা ছোঁড়াছুড়ি সম্পর্ক দু'দিক থেকে আরো বেশি আপোষ মনোভাবাপন্নের দিকে নিতে চাইবেন।
ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রী সেকেন্ড লেডি ঊষা ভ্যান্স মেধাবী ও ধর্মপরায়ণ হিন্দু। তার অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজন ভারতে বসবাস করে। ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যানস এর ওপর যথেষ্ট প্রভাব থাকায় ভারত আমেরিকার কাছেই থাকবে। তুলসি গ্যাবার্ড ভারতীয় না হলেও সাম্প্রতিক হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন, তার ধর্মীয় উন্মাদনা থাকা স্বাভাবিক। তাই বাংলাদেশ নীতিতে ভারত আমেরিকাকে ন্যূনতম হস্তক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারবে।
এবার ট্রাম্পের শেষ মেয়াদ। তাই তিনি চাইবেন তাকে যেন দুনিয়ার মানুষ স্মরণে রাখে। তাই মনে মনে এনভায়রনমেন্টের আন্দোলনের বিরুদ্ধে থাকলেও বাইরে থেকে হোয়াইট ওয়াশ করার চেষ্টা করবেন। তাই লী জেলদিনকে সেক্রেটারি এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন অথরিটি করছেন। স্বামী স্ত্রী দুজনই চার সন্তানের জনক গোড়া ইহুদি পরিবারের সন্তান। ট্রাম্পের ফ্লোরিডার প্রতিবেশী ক্যান্সার সারভাইভর। তার স্ত্রী রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাট সব সময়ই হোয়াইট হাউজে প্রতিরক্ষা নিয়ে কাজ করেছেন। খ্রিস্টান জগত অনেকগুলো ক্রুসেড পরিচালনার পরও জেরুজালেম ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় খ্রিস্টান সংখ্যাগুরু করতে না পারায় মানসিক ব্যর্থতার মনোবেদনা আছে। নিজেরা কোনো দুর্নাম না নিয়ে ইহুদিদেরকে দিয়ে মুসলিমদের সংখ্যালঘু করতে চায়। তাই তারা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে আরব বিদ্বেষী।
গাজাতে ধ্বংস করার মত আর কিছু নেই, আছে কিছু মানুষ। তাই লোক দেখানো হুমকি ধামকি দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ হলেও মাঝে মাঝে হামলা চলবে। জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য আরবদের মাধ্যমে নানান টোপসহ চাপ দেয়া হবে।
তরুণ ডিফেন্স সেক্রেটারি পেটে হেগসেথ এর চরিত্রের সাথে ট্রাম্পের যথেষ্ট মিল আছে। ট্রাম্পের স্পিস রাইটার তরুণ বয়সি স্টিফেন মিলার ডেপুটি পলিসি এডভাইজার চরমপন্থী ইহুদি। তিনি ও অন্যান্য উচ্চ পদের ইহুদিরা ইজরায়েলের পক্ষে উলঙ্গ সমর্থনের জন্য ট্রাম্পকে প্ররোচিত করবেন। ইসরাইল সম্পর্কে ট্রাম্প তাদেরকে কতদূর স্বাধীনতা দেন তা দেখার বিষয়। ইরানের উপর প্রচন্ড চাপ থাকবে। আগের মতই মাঝে মাঝে ইসরাইলকে দিয়ে হামলা করানো হবে। চারিপাশে আমেরিকান ঘাঁটিগুলো পরোক্ষভাবে সাহায্য করবে। ট্রম্পের মেয়াদের শেষ দিকে ইরানের লিবিয়া সিরিয়া কিংবা ইরাক পরিণতি হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভবিষ্যত বলে দেবে ইরানের উপরে আমেরিকা কিভাবে কোন শক্তি প্রয়োগ করে। তবে বলা যায়, কোন না কোন শক্তি প্রয়োগ করবেই।
আমেরিকার যুদ্ধের অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাবে যদি না আরেকটা যুদ্ধ বাঁধায়। তবে যুদ্ধের জন্য অন্য কোন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারের বিষয়টি পরিষ্কার না।
এত কিছুর পরেও ট্রাম্প শান্তিতে থাকতে পারবেন বলে মনে হয় না। ঘরের ভেতরে অশান্তি হবে, বাইরে তো আছেই। গতবারের চেয়ে এবার কম ঘটনাপূর্ণ হলেও সুনাম অর্জন করা খুব কঠিন হবে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর কৃস্টি নোয়েম কড়াকড়ি ভাবেই নির্বাচনের প্রতিশ্রুত অভিবাসন নীতি বাস্তবায়ন করবে। ১৪ মাসের কুকুর হত্যা করার জন্য তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট করা না হলেও প্যালেস্টাইনের গণহত্যার বিপক্ষে কোন বক্তব্য পাওয়া যায় না।
আমেরিকার সবাই অভিবাসী হলেও অভিবাসন নীতি সমষ্টিকভাবে গ্রহণ করবে ,কিন্তু ব্যক্তিক পর্যায়ে পছন্দ করবে না। বাইডেনের সময়ে অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকার মানুষ ভালোই ছিল। কিন্তু তারা মনে মনে অর্থনৈতিকভাবে আমোরকার মানুষ ভালোই ছিলো। কিন্তু তারা মনে মনে ভাবেনি তারা ভালো আছে। বাস্তবের চেয়ে ভাবনার জগতটা অনেক বড়। তাই হানিমুন পার হলে আমেরিকা বেশির ভাগ মানুষ ট্রাম্পের উপর সন্তুষ্ট থাকবে বলে মনে হয় না।
চীন তাদের রপ্তানিমুখী শিল্প (মেক্সিকো ও অন্যান্য দেশে) অন্য দেশে স্থানান্তর করে আমেরিকায় রপ্তানি পরোক্ষভাবে বজায় রাখার চেষ্টা করবে। আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে অবকাঠামো তৈরি করে চীন নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি ও বাজার সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা নেবে। ট্রাম্প প্রশাসনকে ওই সব দেশের উপর নতুন করে নানা বিধি নিষেধ জারি করতে হতে পারে। আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব থাকলেও চীনের উপর মনস্তাত্ত্বিক সামরিক চাপ বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ও হুমকিতে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, ইরানের উপর স্যাংশন ও হামলা সম্ভাবনা এবং ইসরাইলের বাড়াবাড়ির কারণে আমেরিকার উপর পৃথিবীর মানুষের শ্রদ্ধা ক্রমহ্রাসমান হবে।
ট্রাম্প সমচরিত্রের অধিকারী ম্যাট গায়েটজকে অ্যাটর্নি জেনারেল সিলেক্ট করায় আইনি জটিলতার ব্যাপারে সর্বাত্মক সাহায্য পাবেন। উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তার মনোনীতদের অনুমোদন করায় বেগ পেতে হবে বলে মনে হয় না। যত আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব থাকুক না কেন, তার তরুণ সহকর্মীরা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে আমেরিকাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। স্বার্থপরতা থেকে পরর্থপরতার দিকে ধাবিত হলে পৃথিবীর চেহারা আগাবে চার বছরে সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারতো।
লেখক: প্রবাসী