দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৪৩৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকেরা। অভিযোগকারীর হিসাবে এগিয়ে আছেন ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদরা।
আজ মঙ্গলবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে ‘অগ্নিপরীক্ষা: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫ বছরের চিত্র’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। সংবাদপত্র, আদালতের নথি, আইনজীবী, ভুক্তভোগী ও ভুক্তভোগীর স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণাটি করা হয়েছে বলে গবেষণার উৎস অংশে জানানো হয়েছে। এই গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিসটিংগুইশড অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ।
ওয়েবিনারে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, পাঁচ বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ১ হাজার ৪৩৬টি মামলায় ৪ হাজার ৫২০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১ হাজার ৫৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের মধ্যে ৩২ দশমিক ২৭ শতাংশ রাজনীতিবিদ এবং ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ সাংবাদিক। এ ছাড়া ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন।
তিনি আরও জানান, এসব মামলার অভিযোগকারী ৮৫৯ জনের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদরাই বেশি। ৩৩৮ জন অভিযোগকারী রাজনীতিবিদদের মধ্যে ২৬৩ জন ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে জানান তিনি।
ডিজিটাল আইনে মামলার ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলো থেকে সঠিক তথ্য সংগ্রহে জটিলতা, স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, বিচারপূর্ব বন্দী, শিশু-কিশোরদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার মতো বিষয়গুলো উদ্বেগজনক বলে জানান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, ডিএসএর মতো আইনগুলোর বাস্তবায়ন রাজনৈতিকভাবেই হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এমন আইন তৈরি করে তাদের স্বার্থের জন্যই। ভয়ের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, সাংবাদিকরাই নিজেরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, কোন বিষয়ে লিখবেন, কোন বিষয়ে লিখবেন না।
ওয়েবিনারে সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরকারকে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রোশ, ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রকাশের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে তার সঙ্গে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংঘর্ষিক। এই আইন বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে।
এএফপির ব্যুরো চিফ শফিকুল আলম বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনে নাম ছাড়া তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি, তাই ভবিষ্যতে এর অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করা হয়েছিল সাইবার জগৎকে নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্দেশে। তা না করে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, জনসাধারণকে হয়রানি করা হয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ডিএসএ, সিএসএ এ সকল আইন তৈরিই করা হয়েছে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করার জন্য। লালনের গান শেয়ার করার জন্য মুচলেকা দিয়ে একজনকে জামিন নিতে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সুকান্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কবিতা শেয়ার করার জন্য মানুষকে জেল খাটতে হবে। এ রকম কালো আইন প্রবর্তনের পূর্বেই যদি আমরা সোচ্চার হই, তবেই গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হবে।’
ওয়েবিনারের স্বাগত বক্তব্যে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতার প্রকাশ। দেশে যে বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই—তা এই আইনের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট নামক নতুন একটি আইন প্রণয়ন হতে যাচ্ছে, যা আমাদের ডেটার নিরাপত্তার নামে সকল ব্যক্তিগত ডেটা বা তথ্য কুক্ষিগত করার একটি প্রয়াস।’