ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ২৬ অক্টোবর। এর এক সপ্তাহ পরই আগামী ২ নভেম্বর শেষ হচ্ছে বর্তমান উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের মেয়াদ। স্বাভাবিক কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন কবে হবে বা এ প্যানেলে কারা থাকছেন—এ নিয়েই আলোচনা চলছে।
মূলত উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয় সিনেটের বিশেষ অধিবেশনে। তবে এ অধিবেশন কবে ডাকা হবে, তা এখনো জানা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বিশেষ সমাবর্তনের পরপরই বিশেষ অধিবেশনের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল চূড়ান্ত করা হবে। উপাচার্য প্যানেলের সম্ভাব্য তালিকায় বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের সঙ্গে আলোচনায় আছেন আরও পাঁচ অধ্যাপক। তারা হলেন ঢাবির উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এবং ঢাবি নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার।
তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের অভ্যন্তরীণ কিংবা সিনেটের বিশেষ অধিবেশনে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্যানেল নির্বাচন হলে সেখানে আরও কয়েকজনের নাম থাকতে পারে। তারা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদ, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস ছামাদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম। ঢাবির একাধিক সিনেট সদস্য জানান, নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন এবং প্যানেলের বিষয়ে আলোচনা করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে প্যানেল নির্বাচনের জন্য সিনেটের বিশেষ অধিবেশন ডাকেন। সেখানে ভোটাভুটির মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল চূড়ান্ত হয়। আবার বিগত সময়ের বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ ভোটাভুটিও হতে পারে। এরপর প্যানেল পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখান থেকে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির কাছে। এরপর রাষ্ট্রপতি একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি সিনেটের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ও শিক্ষক প্রতিনিধিদের একটি অংশ উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। তারা উপাচার্যকে সিনেট অধিবেশন ও প্যানেল বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার অনুরোধ জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাবি উপাচার্য বলেন, এটি (উপাচার্য প্যানেল) যখন প্রয়োজন হবে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই করবে। সিনেটের বিশেষ অধিবেশন বিশেষ সমাবর্তনের আগে হবে না পরে—এমন প্রশ্নের জবাবেও একই উত্তর দেন তিনি। পদাধিকার, নির্বাচিত ও মনোনীত তিন ক্যাটাগরির ১০৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট। বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন সিনেটের চেয়ারম্যান। তিনি ছাড়াও সিনেটের সদস্য হবেন দুই উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ। এর বাইরে রয়েছেন সরকার মনোনীত পাঁচজন আমলা, স্পিকার মনোনীত পাঁচজন সংসদ সদস্য, আচার্য মনোনীত পাঁচজন শিক্ষাবিদ, ঢাবি সিন্ডিকেট মনোনীত গবেষণা সংস্থার পাঁচজন প্রতিনিধি, ঢাবির একাডেমিক পরিষদ কর্তৃক মনোনীত পাঁচটি অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প কলেজের অধ্যক্ষ, একাডেমিক পরিষদ মনোনীত অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প কলেজগুলোর ১০ জন শিক্ষক, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচিত ২৫ জন প্রতিনিধি, নির্বাচিত ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধি এবং ডাকসু মনোনীত পাঁচজন ছাত্রপ্রতিনিধি। তাদের ভোটেই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয়। তবে ভোটাভুটিতে প্রথম অবস্থানে না থাকলেও প্যানেলে থাকলে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার নজির রয়েছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। যেমন গত বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন অধ্যাপক ড. আমির হোসেন। কিন্তু উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় অধ্যাপক ড. নুরুল আলমকে, যিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ধারা ১১(১) ও ১১(২) অনুসরণ করে দুইভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১১(১) অনুসারে সিনেটে তিনজনের একটি উপাচার্য প্যানেলে নির্বাচন করা হয় এবং সেই প্যানেল থেকে যে কোনো একজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি চার বছরের জন্য উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দান করেন। আর ১১(২) ধারা অনুযায়ী, কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যেমন অসুস্থতা, ছুটি, অপসারণ বা অন্য কোনো কারণে উপাচার্যের পদ শূন্য হলে একজনকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে ঢাবির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে চার বছর এবং পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। অধ্যাপক আখতারুজ্জামানকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রায় দুই বছর এবং পূর্ণাঙ্গ হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। দুজনকেই দুবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়বার কাউকে নিয়োগ দেওয়ার নজির নেই। জানা গেছে, সিনেটের সর্বশেষ উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয় ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জুলাই। বিএনপিপন্থি সাদা দলের অধিবেশন বর্জন এবং অন্য কোনো শিক্ষকের প্যানেল না থাকায় সেসময় অধিবেশনে কোনো ভোটাভুটি হয়নি। আওয়ামীপন্থি তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল কণ্ঠভোটে পাস হয়। তবে এর আগে ৩০ জুলাই নীল দলের শিক্ষক প্রতিনিধি ও রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিরা উপাচার্য প্যানেল মনোনয়নে নিজেদের মধ্যে ভোটাভুটিতে যান। সেখান থেকে তিনজনের নাম চূড়ান্ত করা হয়। সে সময় অভ্যন্তরীণ ভোটে পিছিয়ে থাকলেও উপাচার্য আখতারুজ্জামান নিজেকে এক নম্বর ঘোষণা করে প্যানেল দেন। নীল দলের পক্ষে মনোনীত প্যানেল প্রস্তাব করেন ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম।
এরপর রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি এসএম বাহালুল মজনুন চুন্নু সেই প্রস্তাবে সমর্থন জানান। এ নিয়ে অধিবেশনে শিক্ষকরা প্রশ্ন তুললেও উপাচার্য কোনো জবাব না দিয়ে উপাচার্য প্যানেল ঘোষণা করেন এবং জাতীয় সংগীত বাজিয়ে অধিবেশন সমাপ্ত ঘোষণা করেন। তবে এবার এর পুনরাবৃত্তি হলে শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করবেন এবং প্রয়োজনে আলাদা প্যানেল দেবেন বলে জানিয়েছেন সিনেটের একাধিক শিক্ষক প্রতিনিধি। নীল দল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে নিজ এলাকার লোকদের নিয়োগসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমান উপাচার্যের ওপর রুষ্ট শিক্ষকরা। তারা বলছেন, বিশেষ সমাবর্তন নিয়ে বহু আগ থেকেই আলোচনা চলছিল। কিন্তু উপাচার্য ইচ্ছা করেই কালক্ষেপণ করে এটিকে পিছিয়ে অক্টোবরে নিয়ে গেলেন। তিনি আবারও উপাচার্য হতে চান, সে কারণেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি বিশেষ সমাবর্তনের তারিখ নির্ধারণ করলেন। সাদা দলের জ্যেষ্ঠ এক নেতা বলেন, আমরা এখন সরকার পতনের আন্দোলনে রয়েছি। এমন সময়ে উপাচার্য প্যানেল নিয়ে চিন্তা করার সময় আমাদের নেই। আলাদা কিংবা সংযুক্ত প্যানেল দেওয়া মানেই হলো অবৈধ সরকারের আশীর্বাদপুষ্টদের অনুমোদন দেওয়া। এ ছাড়া সিনেটে প্রায় সবাই আওয়ামী অনুসারী। সে কারণে প্যানেল বিষয়ে আমাদের কোনো ভাবনা নেই।