ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের বিপরীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে ওয়াসার জিমখানা পানির পাম্প। সেই পাম্পের একটি কক্ষে স্তূপ করে রাখা আছে ‘আইল্যান্ড’ ব্র্যান্ডের পানির বোতল। জোর করে ও কর্মচারীদের হুমকি দিয়ে কক্ষটি দখল করে সেখানে পানির বোতল রেখেছেন ‘প্রলয় গ্যাং’-এর সদস্যরা।
এই প্রলয় গ্যাং ঢাবি ক্যাম্পাসে আলোচিত নাম। ২০২০-২১ সেশনের কিছু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীর গড়ে তোলা এই গ্রুপটি এখন ক্যাম্পাসের ত্রাস। নিয়মিত মারামারি, বখাটেপনা, মাদক সেবনসহ বিভিন্ন উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ক্যাম্পাস এলাকায় বোতলজাত পানির ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করে প্রলয় গ্যাং। আর এই ব্যবসার প্রয়োজনেই জিমখানা পানির পাম্পের কক্ষটি দখল করেছেন এই গ্যাংয়ের সদস্যরা।
গতকাল সোমবার দুপুরে পানির পাম্পের একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা সবাই প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের নাম বলেন। সেখানে কর্মরত এক কর্মচারী বলেন, ‘তারা এখানে পানি রাখবে, তারা নাকি নেতা, পানি রাখতে না দিলে রুম ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়। আমরা তাদের কাছে অসহায়।’
প্রলয় গ্যাংয়ের কাছে অসহায় ঢাবি ক্যাম্পাস এলাকার টংদোকানিরাও। শাহবাগ, টিএসসি, মেডিকেল মোড়, চানখাঁরপুল, পলাশীসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা করা ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের ‘আইল্যান্ড’ পানি রাখতে বাধ্য করে প্রলয় গ্যাং। এসব এলাকার দোকানিরা এ নিয়ে অসহায়ত্বের কথা জানালেও ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে আইল্যান্ড পানির সেলস ম্যানেজোর মোহাম্মদ মিলন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী আমাদের কাছ (কোম্পানি) থেকে সরাসরি পানি নিতে চেয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগে। সরাসরি পানি নিতে গেলে যে ক্রাইটেরিয়াগুলো পূরণ করতে হয়, সেগুলো তাদের ছিল না। তবে তারা মনে হয় আমাদের রিসেলারের কাছ থেকে পানি সংগ্রহ করে সাপ্লাই দেয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রলয় গ্যাং তৎপরতা চালালেও গত শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়ের ইবনে হুমায়ুনকে মারধরের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে তারা। সেই মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে গ্যাংটি সম্পর্কে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। এদিকে মারধরের ঘটনায় বাদী হয়ে ১৯ জনের নামে এবং ৬-৭ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী জোবায়েরের মা সাদিয়া আফরোজ খান। এ মামলায় গ্যাংয়ের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ ও কবি জসীমউদ্দীন হলের শিক্ষার্থী নাইমুর রহমান দুর্জয় এবং অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম ও স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী সাকিব ফেরদৌসকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর গতকাল দুপুরে আদালতে তুললে শুনানি শেষে বিচারক তাঁদের কারাগারে পাঠান।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পুলিশ প্রশাসনকে সহযোগিতা করা হচ্ছে সব সময়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ যেন কোনো ধরনের ফায়দা নিতে না পারে সে জন্য সবাইকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানান প্রক্টর।
চিকিৎসককে মারধরেও প্রলয় গ্যাং
গত বছরের ৮ আগস্ট রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. সাজ্জাদ হোসাইনকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। মারধরকারীদের সে সময় শনাক্ত করা না গেলেও ভুক্তভোগী ওই চিকিৎসক সন্দেহ করছেন প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরাই তাঁকে মারধর করেছিলেন। সে সময় মারধরের বিচার চেয়ে মানববন্ধন ও কর্মবিরতি ঘোষণা করেছিলেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। ছবি দেখে ডা. সাজ্জাদ নিশ্চিত করেন, প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্য তবারক মিয়াও ছিলেন তাঁকে মারধরের ঘটনায়।
গ্যাং সৃষ্টির নেপথ্যে গেস্টরুম সংস্কৃতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা গেস্টরুম সংস্কৃতিই এ ধরনের গ্যাং তৈরির পেছনে দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, সংঘবদ্ধ থাকার কারণে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতারাও এসব গ্যাং তোষণ করেন।
এ বিষয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘গেস্টরুম, গণরুম সংস্কৃতি এখন আর নেই বললেই চলে। এসবের বিরুদ্ধে আমরা কাজ করছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করছি।’
প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে সৈকত বলেন, ‘তারা ছাত্রলীগের কেউ না, আগের কমিটি কেন তাদের পদায়ন করছে জানি না। বর্তমান কমিটিতে এদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসনকে ছাত্রলীগ সহযোগিতা করছে।’
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, কোনো গ্যাংয়ের স্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে না। বখাটে, উচ্ছৃঙ্খলদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ প্রশাসনকেও বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।