তথ্যপ্রযুক্তির এক বিস্ময়কর উন্নয়নের যুগে প্রবেশ করেছে বর্তমান পৃথিবী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নজিরবিহীন উন্নতি দারুণ এক চমক সৃষ্টি করেছে এবং সারা বিশ্বকে একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত করেছে। শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিটি উন্নত দেশই নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় এবং উজ্জ্বলতর করতে ভীষণভাবে প্রস্তুত। তথ্যপ্রযুক্তিই এখন জাতীয় উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশে দেশে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিশ্বায়নের প্রশস্ত আঙিনায় দাপুটে বিচরণে এবং আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কতটুকু প্রস্তুত – সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন হয় না।
সুদূর অতীতে কী ঘটেছে সেদিকে খেয়ালি দৃষ্টি নিবদ্ধ করবার বাড়তি প্রয়োজন আপাতত অনুভূত হচ্ছে না। অতি সাম্প্রতিক তথ্যপ্রযুক্তির জিয়নকাঠির স্পর্শে বাংলাদেশও যে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে – এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই কিন্তু উন্নয়নের শম্বুকগতি অবশ্যই দৃশ্যমান। আধুনিক প্রজন্ম বিশেষ করে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি বিপ্লবে অংশগ্রহণে দারুণ আগ্রহ প্রকাশ করছে।
আমাদের দেশে বর্তমানে কম্পিউটর মেলা, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, ওয়েব-ডিজাইনিং প্রতিযোগিতা, কম্পিউটর ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও প্রদর্শনী অহরহ অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমনকি ইলেক্ট্রনিক কমার্সের যাত্রাও শুরু হয়েছে সীমিত পর্যায়ে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই দেশে বেশকিছু ক্ষুদে বিজ্ঞানীর সাক্ষাতও পাওয়া গেছে। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা এবং উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে তাদের গবেষণা অকালেই মুখ থুবড়ে পড়ছে। যদিও দেশে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় এবং তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে সরকারের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। ডেটাবেস উন্নয়ন প্রযুক্তি, সফটওয়্যার উন্নয়ন প্রযুক্তি, নেটওয়ার্কিং, মুদ্রণ ও রিপ্রোগ্রাফিক প্রযুক্তি, তথ্যভাণ্ডার প্রযুক্তি, শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়েছে কিন্তু তা সাধারণের চাহিদা ও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। অফিস- আদালতে এখনও পূর্ণ অটোমেশন সিস্টেম চালু হয়নি। এখনও সেই মান্ধাতা আমলের নথি-লিখন পদ্ধতিতে কর্তৃপক্ষের কাছে নোট উপস্থাপন ও অনুমোদনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে অধিকাংশ অফিসে। একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তির নবতর কৌশল আয়ত্বে এনে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। সুখের বিষয়, আমাদের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায় তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তাদের যোগ্যতা বারবারই প্রমাণ করে দেখিয়েছে।
তারা মেধা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনীশক্তিতে কারও চাইতেই কম নয় কিন্তু সুযোগের অভাবেই পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া এখনও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। এসব সমস্যা চিহ্নিত করে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার কারিকুলামকে যুগোপযোগী ও সর্বাধুনিক রাখার জন্য দেশ-সেরা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করে এবং এ খাতে সর্বাধিক বাজেট বরাদ্দ দিয়ে বিদ্যমান বৈষম্য সম্পূর্ণ দূর করা না গেলেও সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনতে হবে অতি দ্রুত।
উন্নত বিশ্বে এখন মাইক্রোরোবটিক্সের ব্যবহার শুরু হয়েছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে এবং অফিসের কাজ দ্রুততম সময়ে ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করবার জন্য কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তারও ব্যবহার হচ্ছে। এদিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি অথচ আমাদের সন্তানরাই উন্নত দেশে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। কাজেই আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত, সচেতন ও তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানে দক্ষ করে তুলে তাদের শ্রম ও মেধাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ও বেকারত্ব দূরীকরণের চেষ্টায় মনোযোগ দেবার এখনই সময়। এ বিষয়ে একইসঙ্গে সরকারের পাশাপাশি এনজিও, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ধনী ও শিল্পপতিদেরও সক্রিয় ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি একে অপরের পরিপূরক। তাই শুধু প্রযুক্তিগত শিক্ষা নয় বরং শিক্ষা দানেও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার প্রয়োজন। করোনা অতিমারী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে এই বিষয়টিই পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। সে জন্য সবার আগে প্রয়োজন প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানব সম্পদ। বাস্তব ও কঠিন সত্য হলো আমাদের অর্থনৈতিক পশ্চাতপদতা, হীনমন্যতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কার আমাদেরকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিয়েছে। অথচ বর্তমান যুগে প্রযুক্তিগত শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ছাড়া শিক্ষাকে প্রকৃত শিক্ষায় রূপান্তরিত করা এবং আমাদেরকে একটি বিজ্ঞানমনষ্ক জাতিতে পরিণত করা প্রায় অসম্ভব।
প্রযুক্তিকে শুধু ব্যবহার করা শিখলেই হবে না, প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছু নিয়ন্ত্রণ এবং সতর্কতারও যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। সতর্কতা অবলম্বনে সামান্যতম ঘাটতিও মহাবিপদ ডেকে আনতে পারে, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি ঘটাতে পারে। আমরা চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা, ভুপালের গ্যাস দুর্ঘটনা, এবং পরবর্তীতে জাপানের ফুকুশিমা দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর কথা এখনও বিস্মৃত হইনি। বিশ্বের সর্ব প্রথম পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ শুধু ধ্বংসই এনেছিলো, মানুষ মারতে শিখিয়েছিলো। কিন্তু কাকে মারতে হবে এবং বাকিদের কীভাবে রক্ষা করতে হবে সে বিদ্যা-বুদ্ধি কিছুই শেখাতে পারেনি। কাজেই ইতিহাসের কাছে শিক্ষা নিতে হবে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ কতটা জরুরি।
অতি সাম্প্রতিক উদ্ভাবিত প্রযুক্তির একটি হলো ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এর গুরুত্ব অস্বীকার করবার উপায় নেই। ব্যবসায় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে এর রয়েছে ব্যাপক ব্যবহার কিন্তু অপব্যবহারও তো একেবারে কম হচ্ছেনা। ২০১৬-১৭ খ্রিষ্টাব্দে মিয়ানমারে একটি আলাদা মুসলিম স্টেট প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ARSA(Arakan Rohingya Salvation Army) পরিচালিত আক্রণের জবাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং উগ্র-বৌদ্ধ সম্প্রদায় যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো সেখানে ফেসবুকের অপব্যবহার ছিলো নজীরবিহীন। ফেসবুকে উস্কানিমূলক, মিথ্যা তথ্য প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সম্মিলিত এই হত্যাযজ্ঞ বিভীষিকায় রুপ নিয়েছিলো।
তারা প্রায় ২৫ হাজার নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করেছিলো, প্রায় ৬০ হাজার নারীকে প্রকাশ্যে ধর্ষণ করেছিলো, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিলো এবং ৭৩ হাজার রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে বিতাড়ন করেছিলো বলে জানা যায় । সেই সময়ে ফেসবুকে মিথ্যা, বানোয়াট খবর এবং এডিট করা ভয়ংকর দৃশ্য এত বেশি প্রচারিত হয়েছিলো যে তা সর্বৈব সত্য ধরে নিয়ে হত্যাকারীরা বিভিন্ন মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রক্তের নেশায় রাখাইনের রাস্তা চষে বেড়িয়েছিলো হায়েনার মত। এর আগে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রুয়ান্ডার উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রেডিও মাধ্যমে ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়িয়ে তুতসিদের উৎখাত ও নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিলো।
মাত্র ক’বছর আগে বাংলাদেশের বগুড়ায় ফেসবুক ব্যবহার করে মাওলানা সাঈদিকে চাঁদে দেখা গেছে মর্মে গুজব রটিয়ে গ্রামের অতি সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করে কুচক্রীমহল কয়েকশ’ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছিলো। এ বছর ৫ জুলাইয়ের পর এ দেশের একদল কুচক্রী মন্দিরে হামলা হচ্ছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে – এ জাতীয় গুজব ফেসবুকে প্রচার করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাবার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলো। যদিও সচেতন মহল এসব গুজবে কান না দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলো। এসব ঘটনার জন্য ফেসবুক, রেডিও তথা তথ্যপ্রযুক্তিকে দায়ী করা যায় না, দায়ী তারা যারা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। কাজেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচারিত কোনো ঘটনা যাচাই-বাছাই না করে মুহূর্তের উত্তেজনায় ঝাঁপিয়ে পড়া অথবা ঢালাওভাবে প্রযুক্তিকে দোষারোপ করা কোনোটাই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শুধু প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে শিখলেই হবে না, কী কী উপায়ে দুষ্কৃতকারীরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করতে সক্ষম অথবা যথোপযুক্তভাবে ব্যবহৃত না হলে প্রযুক্তি আমাদের জন্য কী কী মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে সে বিষয়েও সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হবে।
আমরা জানি, মেরি শেলি তার রচিত ফ্রাংকেনস্টাইন উপন্যাসে দেখিয়েছেন কীভাবে এক তরুণ বিজ্ঞানী তার নিজের আবিষ্কৃত এক দানবের কাছে কী করুণ পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়েছিলো এবং উভয়কেই ধ্বংস হয়ে যেতে হয়েছিলো।
অতি সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আপাতত ইতিবাচক মনে হলেও এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এর ব্যাপক ব্যবহারে কোটি কোটি মানুষ মেধাশূন্য এবং বেকার হয়ে পড়বে। মানুষের জায়গা দখল করে নেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং এক পর্যায়ে মনুষ্যজাতির বিনাশও ঘটাতে সক্ষম এই প্রযুক্তি। জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, প্রখ্যাত গবেষক, ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিক Yuval Noah Harari শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘মানুষ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শুধু জীবনযাত্রা প্রণালীকে আরামদায়কই করছেনা বরং নিজেদের অজান্তে অনেক বড় সর্বনাশও ডেকে আনছে—বিষয়টি মাথায় রেখে প্রযুক্তির ব্যবহার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়