নেট দুনিয়ায় শাকিব বন্দনা চলছে বেশ দাপটের সঙ্গে। শাকিবের ‘প্রিয়তমা’ ছবিটি ইতোমধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তার বেশ কয়েকটি ব্যতিক্রমী লুক ভক্তদেরকে মাতিয়ে তুলেছে। এ ছাড়া, গানগুলো পাঠক হৃদয়ে দোলা দিয়েছে ভীষণভাবে। প্রায় দুই যুগ ধরে বাংলা সিনেমাপাড়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সুপারস্টার শাকিব খান। বহুমাত্রিক ঝামেলার মুখে পড়েও শাকিব তার হিরোইজম বজায় রেখেছেন। তিনি একের পর এক ভিন্ন ধাঁচের ছবি উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এসব ভিন্ন ধাঁচের ছবির নির্মাণের পেছনে যারা রয়েছেন তারা বয়সে একেবারেই তরুণ এবং মেধাবী।
‘প্রিয়তমা’ ছবির নির্মাতা হিমেল আশরাফ একেবারেই তরুণ। তবে বয়স তার যাইহোক তার নির্মাণশৈলির মেধাকে স্যালুট করতেই হয়। ‘প্রিয়তমা’র কাহিনী লিখেছেন ফারুক হোসেন। তিনিও তরুণ ছিলেন। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে গিয়ে তিনি প্রাণ হারান। কিছুদিন পূর্বে তরুণ নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তরুণ নির্মাতা হিসাবে দীপংকর দীপন, রায়হান রাফি, সৈকত নাসির, অনন্য মামুন, সাইফ চন্দন বেশ ভালো করছেন। এসব নির্মাতারা দর্শকদেরকে নতুনভাবে হলমুখী করতে সক্ষম হচ্ছেন। প্রিয়তমা ছবি দেখতে প্রচুর দর্শক হলে ভিড় করছেন। এটা ইতিবাচক দিক। তরুণ নির্মাতাদের রাষ্ট্রীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করলে তারা আরো সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন। নতুন নতুন আইডিয়া আর চমক নিয়ে তারা সিনেমা পাড়াকে আবার পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারবেন। মনে রাখতে হবে শাকিব খান আমাদের সম্পদ। তাকে টেনে নিচে নামানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয়ে কীভাবে বাংলা সিনেমার ভবিষ্যত আরো মজবুত করা যায় সেটাই ভাবতে হবে।
বিশ্বে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সময়ের বিবর্তনে এবং একই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। আর বাংলাদেশের এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে বাংলা সিনেমা জগত, যদিও এই জগতটি তার অনেকখানি জৌলুস ইতোমধ্যে হারিয়েছে। যেটুকু প্রাণ বাংলা সিনেমা পাড়ায় বিদ্যমান সেটাতেও যেন পরতে পরতে কালিমা লেপনের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ হয়তো শেষ হয়েছে কিন্তু সময়ের তালে যতোটুকু অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিলো সিনেমাপাড়ায় সেটা দৃশ্যমান নয়। আন্তঃদ্বন্দ্ব, সংঘাত আর রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাংলা সিনেমা পাড়াকে এখন কৃমি কীটে খাওয়া দগ্ধ লাশের চেহারার সঙ্গে তুলোনা করা যেতে পারে। একটা সময় ছিলো যখন সিনেমা জগৎকে কেন্দ্র করে বহুমাত্রিক ব্যবসা গড়ে উঠেছিলো। দেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছিলো বহু সিনেমা হল যেখানে প্রতিনিয়ত লেগে থাকতো দর্শকদের ভিড়। বহু মানুষের কর্মসংস্থান হতো। নায়ক নায়িকাদের ভিউকার্ড বিক্রি করে হাজারো মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন। রিকশার পেছনে নায়ক নায়িকাদের ছবি শোভা পেতো। রং তুলি দিয়ে অনেক অর্থ উপার্জন করতো। একটি সিনেমার সঙ্গে বহু মানুষের জীবিকা জড়িত থাকে। প্রযোজক, পরিচালক, অভিনয় শিল্পী, সংগীত শিল্পী, পরিবেশকসহ নানা পদের মানুষের। একটি সিনেমার আর্থিক মূল্য যেমন রয়েছে, তেমনি এর শৈল্পিক মূল্য সীমাহীন। বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এই সিনেমাপাড়া।
প্রযুক্তির কারণে সিনেমাপাড়ার সেই পূর্বের জমজমাট অবস্থা এখন আর নেই। একটা সময় ছিলো যখন দেশের মানুষেরা পরিবার সহ সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেতো। সিনেমা দেখে হল থেকে বের হয় সিনেমার গানগুলো মনের আনন্দে গাইতো এবং সিনেমার গল্প অন্যকে শোনাতো। কিন্তু আজ ইউটিউব, মোবাইল আর নেট দুনিয়ার কারণে মানুষ অনেকটা হল বিমুখ হয়ে পড়েছে। হল বিমুখ হওয়ার পেছনে এটাই অবশ্য একমাত্র কারণ নয়। আরো বহুবিধ কারণ রয়েছে এর পেছনে। সেগুলোর মধ্যে মানহীন সিনেমা তৈরি, সামাজিক ও পারিবারিক গল্প না থাকা, অশ্লীলতা, পাইরেসি, হলমালিকদের সঙ্গে সিনেমাপাড়ার লোকদের সম্পর্কের অবনতি, সিনেমাপাড়ায় অপরাজনীতিসহ আরো অনেক কারণ।
বিশ্বের সর্বত্রই সিনেমা জগতে এক ধরনের খরা চলছে। তবে বাংলা সিনেমাপাড়ায় এর প্রকট অনেক বেশি। গত ২৮ জানুয়ারি ২০২২র অনুষ্ঠিত হয়েছিলো চলচিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন। সামান্য এই নির্বাচনকে ঘিরে যতোটা উত্তেজনা দেখা গেছে দেশব্যাপী তা জাতীয় নির্বাচনকেও মনে হয় হার মানিয়েছে। ইউটিউব, ফেসবুকসহ গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে নির্বাচনের সংবাদ। সেলিব্রেটিদের এই নির্বাচনের প্রতি দৃষ্টি ছিলো সবার। নির্বাচনকে ঘিরে কাদা ছোড়াছুড়ি কম হয়নি। জলও ঘোলা হয়েছে যথেষ্ট। বাদ, প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে এখনো। দুটি প্যানেলের মধ্যে তর্কযুদ্ধের বিস্ফোরণ দৃশ্যমান হয়েছে। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থাকবে কিন্তু সেটা নিয়ে দুটি প্যানেল যা করছে তা রীতিমত হতাশাব্যঞ্জক।
পূর্বে সিনেমাপাড়ার ভেতরের এতো খবর পাওয়া যেতো না। সেলিব্রটিরা এক ধরনের আলাদা ব্যক্তিত্ব নিয়ে থাকতেন। কিন্তু ইদানিং নানা ইউটিউব চ্যানেলে তাদের যে আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে তা মোটেও কাম্য নয়। আমার প্রশ্ন হলো চলচ্চিত্রের উন্নয়নে শিল্পী সমিতির নির্বাচন কতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ? সিনেমা তৈরি করে প্রযোজক ও পরিচালকেরা। শিল্পীরা অভিনয় করেন। সিনেমা তৈরিতে প্রযোজক ও পরিচালোকদের ভূমিকাই মূখ্য মনে হয়। কিন্তু শিল্পী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিচালক ও প্রযোজকদের সঙ্গে যে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে নির্বাচনের দিন তা ছিলো অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।
চলচ্চিত্রের উন্নয়ন আসলে এককভাবে কারো উপর নির্ভর করে না। সবার মধ্যে যদি সুষ্ঠু সমন্বয় থাকে তবে এ শিল্পের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সিনেমাপাড়ার মানুষগুলো তাদের নিজেদের দ্বন্দ্বকে এমনভাবে প্রকট করে তুলেছে যে এখন সিনেমার ভবিষ্যৎ রীতিমতো খাদে পড়ে আছে। শিল্পের চেয়ে রাজনীতি যখন বেশি প্রাধান্য পায় তখন আর সেটা শিল্প থাকে না। রাজনীতির বেড়াজালে আটকা পড়ে এক অদৃশ্য ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। সিনেমা বোদ্ধারা এটাকে সিনেমার জন্য একটি বড় হুমকি হিসাবে দেখছেন। সিনেমা হলের সংখ্যা কমতে কমতে এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। হলমালিকদের একটাই কথা ব্যবসা না হলে তাদের করণীয় কিছু নেই। প্রচুর ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে তারা হল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। হলমালিকদের কথায় যুক্তি আছে তবে সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে তাদের কার্যকরী কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে হতো, কিন্তু তারা একমুখী সিদ্ধান্ত নিয়ে এই শিল্পের অগ্রযাত্রায় বিপরীত রোল প্লে করেছেন।
প্রযোজকরা অর্থ লগ্নি করেন অধিক আয়ের আশায়। তারা সিনেমায় টাকা ব্যয় করেন তাদের ব্যবসার স্বার্খে। কিন্তু সিনেমা তো শুধু ব্যবসার জায়গা না, এতে শিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। মানহীন শিল্প দিয়ে কখনো স্থায়ী ব্যবসা হয় না, সাময়িক ঝংকার তোলা যায় মাত্র। কিছু প্রযোজক সেই স্বল্পমাত্রার পিলটিই গিলেছেন। দ্রুত টাকা বানাতে কাটপিস আর অশ্লীলতার আশ্রয় নিয়েছেন। সিনেমার এই কাটপিস আর অশ্লীল দৃশ্যের কারণে মানুষ পরিবারসহ সিনেমা হলে আর যেতে রাজি হয়নি। আর এর ফলেই শুরু হল দর্শক খরা।
যাহোক সিনেমাপাড়ার ধস ঠেকাতে কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু রাজনীতি আর আন্তঃদ্বন্দ্বে তা ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। সিনেমাপাড়ার ফ্লোরগুলো যাদের পদচারণায় মুখরিত থাকতো তারা বছরে একবার সেখানে আসেন কি না সন্দেহ। একদিকে. শিল্পী সংকট, অন্যদিকে নোংরা রাজনীতি সিনেমাপাড়ার বারোটা বাজিয়েছে। একটি সিনেমা জগত এক নায়ক কেন্দ্রিক হতে পারে না, কিন্তু সেটাই হয়েছে। সরিষার মাঝে ভূত এমনভাবে ঢুকে আছে যেটাকে হাজার তন্ত্র-মন্ত্র দিয়েও বের করা যাচ্ছে না। সিনেমাপাড়ার জন্য সরকারি বরাদ্ধ বৃদ্ধি করাসহ নানা উদ্যোগ তথ্য মন্ত্রালয়ের আছে। কিন্তু গাছের শিকড় কেটে উপরে পানি ঢেলে কোনো সমাধান আসবে কি?
সিনেমার সংখ্যা যদি বাড়ানো যায় তাহলে শিল্পীরা কাজ পাবে এবং সহজ হবে তাদের জীবিকা। কিন্তু সিনেমার সংখ্যা বাড়ালেই কি সব সমস্যার সমাধেন হবে? মোটেও না। মানসম্পন্ন সিনেমা বানাতে হবে। সিনেমায় বড় বাজেট দিতে হবে। সবচেয়ে যেটা বেশি প্রয়োজন সেটা হলো সমন্বয়। সিনেমাপাড়াকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি সংগঠন আছে। এই সংগঠনগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় করতে হবে আর সেটা করতে হলে সরকারকে সুনজর দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি এই সিনেমা জগতকে বাঁচানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ এতোটুকুই বলতে চাই যে সিনেমাপাড়ায় যে রেষারেষির সংস্কৃতি চালু হয়েছে সেটা থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। অন্যথায়, বড় মাশুল গুনতে হবে প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে। তাই ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে সামিল হতে হবে সবাইকে। বহু মতকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে রাজনীতি আর শিল্প সমান্তরাল চলে না। শিল্পের জন্য প্রয়োজন ত্যাগ, দ্বন্দ্ব নয়।
লেখক : মাজহার মান্নান, কবি ও কলামিস্ট