কোটা সংস্কারের আন্দোলন ঘিরে দেশে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি এবং কারফিউ জারি হওয়ায় দেশের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। একের পর এক স্থগিত করতে হচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষা। এরই মধ্যে শত শত পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
গত দুই সপ্তাহে পিছিয়েছে এইচএসসিরি চার পরীক্ষা। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে মাধ্যমিক স্তরের ষাণ্মাসিক পরীক্ষাও স্থগিত হয়েছে। চলমান এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৫ জুলাই পর্যন্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। পরীক্ষাগুলো কবে, কখন, কীভাবে হবে তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।
এ প্রেক্ষিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ২৮ জুলাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত হবে কি না, সেটা দেশের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে স্থগিত করা হবে।
এদিকে একাডেমিক, পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও পেছাতে হচ্ছে। ফলে পরীক্ষাজট তৈরির আশাঙ্কাকরছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে বিপাকে পড়েছে অন্তত ৭০ লাখ শিক্ষার্থী। আন্দোলনের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা পেছাচ্ছে। একই কারণে এক সপ্তাহে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও স্থগিত করতে হয়েছে।
অন্তত পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে । কারফিউ চলায় প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারও বন্ধ। এদিকে গত ১ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রতয় বাতিলের দাবিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেন। একই দিন কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীদের একাংশ । তারা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি দেন। এতে ১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। জুলাইযের দ্বিতীয় সপ্তাহে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কোটা সংস্কারের আন্দোলনে যোগ দেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে ১৮, ২১, ২৩ ও ২৫ জুলাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা এরই মধ্যে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এই চার দিনে ভূগোল, রসায়ন প্রথমপত্র, রসায়ন দ্বিতীয় পত্র এবং অর্থনীতি বিষয়ের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো।
আন্তশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার গত সোমবার দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, পিছিয়ে দেয়া পরীক্ষার পরিবর্তিত সময়সূচি এখন ও চূড়ান্ত হয়নি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর হবে। গত ২০ জুলাই ছিলো দেশের সব সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। ১৫ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষাটি স্থগিত করার ঘোষণা করা হয়। এই পরীক্ষার পরবর্তী তারিখ পরে জানানো হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। এখনো সেই তারিখ নির্ধারণ হয়নি। দেশের ৯টি সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ে এই ভর্তি পরীক্ষায় কয়েক হাজার পরীক্ষার্থী অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন উত্তাল রূপ নিলে গত ১৬ জুলাই সরকারি ও বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে উপাচার্যদের চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। একই সঙ্গে আবাসিক হল ত্যাগের জন্য শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দিতে বলা হয়। পরদিন ছিলো পবিত্র আশুরার ছুটি। এদিন সকাল থেকে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা আসে। হল ছাড়তে বাধ্য হন আবাসিক শিক্ষার্থীরা। একই দিন অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের সব মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও টেক্সটাইল কলেজে ছুটি ঘাষণা করা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত প্রায় আড়াই হাজার কলেজেও এদিন ছুটি ঘোষণা করা হয়। এভাবে এরই মধ্যে তিন শতাধিক পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে।
ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান তুহিন গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষা স্তরে এই মুহূর্তে ৪৭ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। বর্তমান পরিস্থিতে তাদের লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে। এ নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন।
দেশে মাধ্যমিক স্তরে (মাদরাসাসহ) শিক্ষার্থী ২ কোটি ৮০ লাখের মতো। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) সৈয়দ জাফর আলী বলেন, মাধ্যমিক স্তরের প্রায় তিন কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাহত হচ্ছে। একের পর এক পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে।
তিনি জানান, দেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬২৮টি। আর বেসরকারি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৮ হজার ৩৪০টি। এই দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ৮১ লাখ ৬৩ হাজার ১০৮ জন। এর বাইরে বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে কয়েক হাজার। তাতে শিক্ষার্থী ২০ লাখের বেশি। এ ছাড়া সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে ১৫ হজার। এগুলোর শিক্ষার্থী ১৫ লাখ। আর বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজে অন্তত ৯৩ হাজার ছাত্রছাত্রী পড়ছেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে আশুরার পর প্রথমে সিটি করপোরেশন এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরে সারাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬২০টি। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ১ কোটি ৪০ লাখের মতো। এর বাইরে কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট স্কুল রয়েছে প্রায় ৬০ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে দুই লাখ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছেন।
তিনি আরো বলেন, আর স্থগিত পরীক্ষাগুলো কবে হবে, তার তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। তবে আগামী ১১ আগস্ট এইচএসসির পরীক্ষা শেষ হবার পরে স্থগিত হওয়া পরীক্ষাগুলো নেয়া হবে।