এক বছরের ব্যবধানে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় কমেছে চার হাজারের বেশি। আর দুই বছরে তা কমেছে ১৮ হাজারের বেশি। তবে বিদ্যালয় কমলেও এক বছরের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থী বেড়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারিতে (এপিএসসি) এই তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি এই শুমারির প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অধিদপ্তর। সর্বশেষ প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারিতে আগের কয়েক বছরের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেসব তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষায় কিছু ক্ষেত্রে অবনতি হলেও ঝরে পড়া কমাসহ অন্য কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মোশতাক আহমেদ।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, যদিও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অন্য এক প্রতিবেদনের (জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ২০২২) তথ্য বলছে, শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যেসব যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করার কথা, তা অর্জন করতে পারছে না বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। এর মধ্যে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। আর তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না।
বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির তথ্য বলছে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি ও বেসরকারি (কিন্ডারগার্টেনসহ) প্রাথমিক স্কুল ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ২টি। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে কমে হয় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি। আর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তা কমে হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টি; যার মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে প্রাথমিক বিদ্যালয় কমেছে ১৮ হাজার ৪৬৩টি। মূলত কমেছে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক উত্তম কুমার দাশ বলেন, মূলত একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার লার্নিং সেন্টার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মোট সংখ্যাটি কমেছে। কিন্তু কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কমেনি।
শুমারির তথ্য বলছে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে সারা দেশে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯১ জন, যা আগের বছর ছিল ২ কোটি ৯০ হাজার ৫৭ জন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৩৪ জন শিক্ষার্থী বেড়েছে। আর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজারের বেশি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ১ কোটি ৫ লাখ ২১ হাজার ১৪০ জন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মোট শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭০৯ জন। এর মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী শিক্ষক। উল্লেখ্য, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী কোটা রয়েছে। মোট শিক্ষকদের মধ্যে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬২৫ জন শিক্ষক পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় গড়ে একজন শিক্ষকের বিপরীতে ৩৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।
ঝরে পড়ার হার আরও কমেছে
একটি সময় দেশে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল অনেক বেশি। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ও প্রাথমিকে ভর্তি হওয়ার পরও প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করেই ঝরে পড়ত। তবে এখন ধারাবাহিকভাবে ঝরে পড়ার হার কমছে। সর্বশেষ তথ্য বলছে, এখন প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এর মানে হলো প্রাথমিক যত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তাদের মধ্যে ৮৬ শতাংশই এখন প্রাথমিক শিক্ষা (পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত) সম্পন্ন করতে পারছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে এই হার ছিল ১৪ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া প্রায় ৯৭ শতাংশ বিদ্যালয় গমনোপযোগী শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
এদিকে প্রাথমিক শিক্ষায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এবার এ ধরনের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার। যার মধ্যে মেয়েশিশু ৪৪ শতাংশের কিছু বেশি। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে এ ধরনের শিক্ষার্থী ছিল ৯৯ হাজারের কিছু বেশি।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। দীর্ঘ ১৮ মাস পর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নতুন করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়। করোনাকালে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিখনক্ষতি নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির এক গবেষণায় উঠে এসেছিল, করোনা মহামারির সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি আরও বেড়েছে। ওই গবেষণার তথ্য বলছে, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের অনেকে বিদ্যালয় ছেড়েছে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে গেছে। এখন কেন পরপর বিদ্যালয় কমছে, সেটার একটি সঠিক অনুসন্ধান করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।