বিংশ শতাব্দীর ২০ থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত রাজনীতিতে ছিলো দেশাত্ববোধের অনন্য জাগরণ। সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাজনীতিকদের সম্পর্ক ছিলো সমান্তরাল। ৪৭ এর দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে নানা ইস্যুতে দূরত্বের দানা বাঁধতে শুরু করে। তখন দুই পাকিস্তানের মধ্যে যে বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যের বিষবাস্প ছড়ায়, তার প্রধান এবং প্রথম কারণ ছিলো ভাষার দূরত্ব। একে তো পশ্চিম পাকিস্তানিরা সরকারের সমস্ত প্রশাসনিক দপ্তর ছিলো তাদের কব্জায়; তার ওপর উর্দু ভাষাভাষী পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে বাংলা ভাষাভাষী পূর্ববঙ্গের জনগণ (বর্তমান বাংলাদেশ) সরকারি-বেসরকারি চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। এতো কিছুর পরেও উদার মানবিক সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞাবান চেতনার অধিকারী বাঙালির গুটিকয়েক রাজনীতিকদের সুদূরপ্রসারী চিন্তার গুণে সৃষ্টি হয় ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার মুক্তিযুদ্ধ। তখন রাজনীতি ছিলো অনেকটা স্বচ্চ এবং রাজনীতিকরা ছিলেন সম্মানিত অধিকারী।
জনগণের জন্য ছিলো সেবার সর্বোচ্চ মানসিকতা। সেই রাজনীতির নীতি আদর্শ এখন নির্বাসিত! রাজনীতিতে অসম্মানীর কদর বেশি। নীতিহীন কপট মানুষরা হয়ে ওঠে রাজনীতির চালিকা শক্তি! যে যতোবেশি অপকর্ম করতে পারে তার কদর ততো বেশি। অপরাজনীতির ছলাকলা দেখতে দেখতে দেশের মানুষের মতো আমি নিজেও ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। রাজনীতি হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে ক্ষেতের ফসলের মতো; সেবার পরিবর্তে পকেট মোটা তাজা করার প্রধান ক্ষেত্র। পেশীশক্তি আর পূঁজিবাদীদের দৌরাত্ম্য। রাজনীতির গড ফাদার খ্যাতদের নজরে কোনোরকমে একবার নিজেকে উন্মোচন করতে পারলে তাকে আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয় না।
বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির কোনো মিল নেই। বিশ্ব রাজনীতি এগিয়ে যায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে আর আমাদের দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয় অস্ত্রবাজ, ঠেন্ডারবাজ, মাদক কারবারি, গুন্ডা এবং যারা নেতাকে অর্থ-বিত্তসহ বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে তুষ্ট করতে পারা হোমরা চোমরাদের নিয়ে। আমাদের দেশের রাজনীতি হয়ে উঠেছে পরিবার কেন্দ্রীক। এ ধারা বিস্তৃতি ঘটেছে কেন্দ্র থেকে মফস্বলে পর্যন্ত। যে ব্যক্তি এমপি, মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বার হন, তিনি প্রতিবারই হতেই থাকেন। পাঁচ বছর মেয়াদের সময়ে একেকজনকে ৮ বার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হওয়ারও রেকর্ড আছে। একজন লোক যদি ৮ বার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন তার মেয়াদ সময় দাঁড়ায় ৪০ বছর। এই ৪০ বছর একজন ব্যক্তি শাসন করার ফলে এলাকায় জারি হয় এক অঘোষিত একনায়কতন্ত্র। এতে করে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারে না। মেধাবী দেশপ্রেমিক জনগণ বঞ্চিত হন অধিকার থেকে। এর ফলে অনেকের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ, অশ্রদ্ধা জন্ম নেয়। কোনোরকমে একবার সরকারি জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লেখাতে পারলে তাকে আর ঠেকানোর উপায় থাকেনা। ভাব দেখায় এলাকাটা যেন তার লীজ নেয়া।
বিশেষ করে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এমন হাল অবস্থা দেখতে দেখতে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে। ছলেবলে, কৌশল কিংবা অপকৌশলে একবার ক্ষমতায় আরোহণ করতে পারলে জনগণ হয়ে যায় তাদের কাছে ছক্কার ঘুঁটি। শাসকরা মনে করতে থাকেন দেশের সব মানুষ তাদের হাতের পুতুল ‘যেমন করে নাচাবে, তেমনি নাচবে। সোজাকথা কোনো সরকারই জনগণের স্বার্থের পক্ষে ছিলো না। তাদের কর্মকাণ্ড ছিলো সীমাহীন জনবিরোধী। সাধারণ জনগণকে শাসক ও তাদের সমর্থনপুষ্ট নেতাকর্মীরা নানাভাবে শোষণ করে। এখন সময় এসেছে এ জাতীয় রাজনীতিক ও তাদের দোসরদের প্রত্যাখ্যাত করার।
রাজনীতিতে এখন নতুন উদ্যেম শুরু হয়েছে। দেশের মেধাবী ছাত্ররাই এর মূল উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অনেকের মনে নতুন আশা সঞ্চারিত হয়েছে। বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতির আদলে গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উন্নত জীবনের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি ব্যর্থ হয় এই বাংলাদেশের অদূর ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন! শেখ হাসিনার সরকারকে পতন করার মধ্যে দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি দুইজন তরুন অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হয়ে দেশের রাজনীতিক অঙ্গনে নবধারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে যুক্ত হয়েও বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এই ব্যাপারটি বাংলাদেশ শুধু নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বলা যায় একটি নতুন মডেল। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গিয়ে ছাত্র, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্যে দিয়ে তৃণমুলের আশা আকাঙ্ক্ষা জানা ও বোঝার চেষ্টা করছে, যা রাজনীতিক অঙ্গনে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে।
দেশে পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এখন খুব জরুরি। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে প্রথমে রাজনীতিক, রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংস্কার প্রয়োজন। মানুষকে শুদ্ধতার পাঠ নিতে হবে, রাজনীতিতে শুদ্ধতার চর্চা শুরু করতে হবে। পেশিশক্তি পরিহার করতে হবে। এ কথা সত্য, রাজনীতির মধ্যে দুর্বৃত্তায়নগোষ্ঠী বাসা বেঁধেছে। গুণী রাজনীতিকদের স্থলে চোরাকারবারী, মাদক ব্যবসায়ী, সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের অনেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে দেশকে নষ্টদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। যেকোনো প্রকারে রাজনীতি থেকে দুর্বৃত্তায়ন ও পূঁজিবাদী গোষ্ঠীকে উৎখাত করে সুস্থধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেধাবী তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিকরা এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হওয়ার মতো গৌরব অর্জন করেছেন। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্মদের গড়ে তুলতে সেরকম কোনো পদ্ধতি বা পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। আমি মনেকরি আমাদের তরুণ প্রজন্মের সন্তানরা অন্যান্য দেশে যেহেতু তাদের কর্মদক্ষতা দেখাতে পারছে এখানেও পারবে। তরুণদের নতুন নতুন চিন্তা শক্তি কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক