দেশে উচ্চশিক্ষার মান কতোটা বাস্তবসম্মত - দৈনিকশিক্ষা

দেশে উচ্চশিক্ষার মান কতোটা বাস্তবসম্মত

ওসমান গনি |

একজন মানুষের জন্মের পর তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সবার আগে যে জিনিসটি প্রয়োজন তাহলো শিক্ষা। আমরা জানি মানবকুলে জন্ম হলেই মানুষ হওয়া যায়  না। সে হয় আকৃতিগত মানুষ। মানুষ তখনই মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যখন সে সুশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে নিজেকে মানুষরূপে প্রকাশ করে। একজন মানুষ সত্যিকারের মানুষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হলে সেটা শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এজন্যই শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আজকের লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে দেশের উচ্চ শিক্ষার মান-মর্যাদা নিয়ে। আসলে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে কিভাবে চলছে শিক্ষা আর সে উচ্চশিক্ষার মানই বা কতোটুকু বাস্তব সম্মত।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বাধীনতার পর থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মানের ক্রমে অবনতি হয়েছে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা লাভের প্রধান মাধ্যম হলো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার পর সাধারণত একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে চার বছরের অনার্স ও এক বছরের মাস্টার্স কোর্স পড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে কলেজগুলোতেও চার বছরের অনার্স কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। 

আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে এখন যতোটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তা কি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে জানা প্রয়োজন, দেশে প্রকৃতপক্ষে কতোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা আছে। যতোদূর জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা কখনোই যাচাই হয়নি এবং হওয়ার কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের কথা, তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১১টি। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো না। তখন উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীদের ভর্তির জন্য ওই ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক আসন ছিলো না। এই প্রেক্ষাপটে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করে অনুমোদন প্রদান করে। উচ্চশিক্ষা দানের একটা নতুন পথ খুলে যায়। এটা ছিলো সরকারের একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সেই থেকে এ পর্যন্ত দেশে ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও ৫৬টিতে উন্নীত হয়েছে। এতো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরও দেখা গেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসনের অভাব বা সংকট রয়েছে। ওদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকটি বাদে অধিকাংশই শিক্ষার্থী সংকটে ধুঁকছে। আবার প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে শিক্ষার জন্য। বিদ্যমান এই বাস্তবতার মধ্যেও নতুন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর চাপ থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার সুযোগ কম ও মান যথাযথ না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের একাংশ বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাহলে এতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে লাভ কী হলো?

রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের হাট-বাজার বসে গেছে। রাজধানীতে পাবলিক ও বেসরকারি মিলে ৬৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ধানমন্ডি, বনানী, মিরপুর, উত্তরা, বসুন্ধরা প্রভৃতি এলাকায় রাস্তার এ মাথায় ও মাথায় বিভিন্ন নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। ওদিকে জেলা শহরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চলছে। নজির হিসেবে কুষ্টিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। কুষ্টিয়া একটি ছোট্ট শহর। এখানে অনেক আগেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আছে। জানা গেছে, ইতোমধ্যে লালন ও রবীন্দ্রনাথের নাম যুক্ত করে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যাদের অনুমোদন হয়ে গেছে। প্রশ্ন ওঠে, নাম সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কী হবে, যদি শিক্ষার মান না থাকে? হাতে গোনা দু’চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান, পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা ভালো। অধিকাংশেরই এসবের বালাই নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ছাড়া নিজস্ব কিছু নেই। জমি নেই, বিল্ডিং নেই, স্থায়ী শিক্ষক নেই, প্রয়োজনীয় ক্লাসরুম নেই, লাইব্রেরি নেই, ল্যাবরেটরি নেই, নেই গবেষণার কোনো ব্যবস্থা ও সুযোগ। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত সার্টিফিকেট ব্যবসার জন্য করা হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, শিক্ষা এখন বড় ধরনের লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ব্যাংকের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এ সময় সবচেয়ে বেশি মুনাফাদায়ী। বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকের যেমন শেষ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমনি শেষ নেই। শুরুতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ছিলেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগীরা। এখন এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দখল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ আছে, এমন ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিরাই ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ব্যাংক লুটপাটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চবেতনখোর ও সার্টিফিকেট বেচার দোকানে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে মুনাফা শিকারি প্রতিষ্ঠানের আদৌ প্রয়োজন আছে বলে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। শিক্ষাবিদরা তুলেছেন। তাতে তেমন কোনো ফলোদয় হয়নি। যেসব শর্তপূরণ সাপেক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা, তার অধিকাংশ পূরণ না করেই বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। ইউজিসির হুমকি-ধামকি, সময় বেঁধে দেয়া কোনো কাজে আসছে না। ইউজিসি চরম কোনো সিদ্ধান্তও নিতে পারছে না অক্ষমতার কারণে। রাজনৈতিক কানেকশনে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা কি ইউজিসির আছে?

অত্যন্ত বেদনাদায়ক দেশের সরকারি-বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক মানের সমান নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের করা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। দুয়েকটির নাম পাওয়া গেলেও একেবারে নিচের দিকে। কিউএস বিষয়ভিত্তিক র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের মাত্র দুটি এবং এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে। শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে, এ থেকেই উপলব্ধি করা যায়। শিক্ষার অবনতমান ও সার্টিফিকেট সর্বস্বতার কারণে মেধা বিকাশ যেমন ব্যহত হচ্ছে, তেমনি দক্ষ জনশক্তি তৈরির আকাঙ্ক্ষাও অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যেভাবেই হোক সার্টিফিকেট লাভ করছেন বটে, কিন্তু তা তাদের কর্মজীবনে কোনো কাজে আসছে না। বিশেষ তয়-তদবিরে কোথাও কাজ পেলেও দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারছেন না। অধিকাংশেরই বেকারত্বের অভিশাপ বহন করতে হচ্ছে। বেকার বানানোর এ শিক্ষার কী দরকার? দেশে-বিদেশে দক্ষ কর্মীর কদর বেশি। অথচ আমাদের দেশে দক্ষ কর্মী তৈরি করার শিক্ষার বড় অভাব। এ কারণে বেকারের ভারে ন্যুব্জ এদেশেকেই বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী আনতে হচ্ছে। ঢাকা চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) তরফে সম্প্রতি জানানো হয়েছে, শিল্প খাতে অনেক বিদেশি কাজ করছে। তারা প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার শিক্ষার ঘাটতিই যে এর বড় কারণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জীবনের কর্মক্ষেত্রে সুনিপুণ ও দক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জন করাই শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তার শোচনীয় অভাব রয়েছে। শিক্ষাকে মূল্যবোধসম্পন্ন ও কর্মমুখী করার বিকল্প নেই। সার্টিফিকেটসর্বস্ব ও অবনতমানের শিক্ষার আমাদের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও। মানসম্পন্ন শিক্ষা ও মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমাদের চাই এবং তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : ওসমান গনি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041618347167969