অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর ভেঙে দেওয়া হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। তবে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় ওই সংসদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের ফেসবুক পোস্টে মন্তব্যের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ অপ্রপচার চালানো হয়েছে। আর এ কাজে বট (বিশেষ সফটওয়্যার) নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগে ডিসমিসল্যাব প্রায় ১ হাজার ৩৬৯টি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এ-সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব।
এতে বলা হয়, ভুয়া ফেসবুক প্রোফাইলগুলো থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৯৭টি পোস্টে সমন্বিতভাবে ২১ হাজারের বেশি মন্তব্য করা হয়েছে। একই মন্তব্য বিভিন্ন প্রোফাইল থেকেও পোস্ট করা হয়েছে।
বট নেটওয়ার্ক একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যেখানে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে কাজ করা হয়। ডিসমিসল্যাব বলেছে, বট অ্যাকাউন্ট ও এর মন্তব্যের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ তারা মাত্র ১৯৭টি পোস্টে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডি নিউজের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে গত ২১ জুন ‘কালার প্রিন্টারে ছাপানো প্রতি পৃষ্ঠায় থাকে অদৃশ্য কোড?’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরের নিচে ‘এবারের নির্বাচন স্বচ্ছ হবে। আগামী নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। এবার ভোট চুরি করতে পারবে না বলেই বিএনপি নির্বাচনে আসতে ভয় পাচ্ছে, আর এত কাহিনি করছে’– এমন মন্তব্য ডিসমিসল্যাবের চোখে পড়ে। নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস পরে এমন মন্তব্য যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, ব্যবহারকারীরা বিএনপির সমালোচনা, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সফল ও সুষ্ঠুভাবে হওয়ার আশাবাদ, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজনের দাবিসহ নানা রাজনৈতিক বিষয়ে একের পর এক মন্তব্য করে যাচ্ছে।
নির্বাচনের এতদিন পরে কেন এমন মন্তব্য, তাও সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক খবরে– এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটি বট নেটওয়ার্কের সন্ধান পায় ডিসমিসল্যাব। তারা দেখেছে, এ অ্যাকাউন্টগুলো বিভিন্ন পোস্টে একই মন্তব্য করেছে এবং সেটি বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকেও পোস্ট করা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, বট নেটওয়ার্কটি সক্রিয় হয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন পর্যন্ত তারা ঘুরেফিরে ৪৭৪টি রাজনৈতিক মন্তব্য করেছে। মন্তব্যগুলো নির্বাচনের আগে তৈরি করা। কিন্তু তারা নির্বাচনের পরেও একই মন্তব্য পোস্ট করে গেছে এবং দেশের প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম ও বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পেজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।
প্রোফাইলগুলো সক্রিয় হয়েছে মূলত ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের জুন থেকে নভেম্বরে, নির্বাচনের আগ দিয়ে। শুধু ২৩ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রথমবারের মতো পোস্ট করা হয় ৩৪৪ অ্যাকাউন্ট থেকে। এর আগে ২ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর ২৪০টি প্রোফাইল সক্রিয় হয়।
সংশ্লিষ্ট প্রতিটি অ্যাকাউন্ট আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাদের বেশির ভাগেরই প্রোফাইল লক বা প্রাইভেট, সেগুলো সক্রিয় নির্বাচনের আগে, প্রোফাইল ছবি নেই অথবা চুরি করা, তাদের বন্ধু সংখ্যা খুবই কম বা নেই এবং বেশির ভাগ অ্যাকাউন্ট দুটি নির্দিষ্ট ‘বাংলার খবর’ ও ‘আওয়ামী লীগ মিডিয়া সেল’-এর ফেসবুক পেজের ফলোয়ার।
প্রোফাইলগুলোর বেশির ভাগই (৭৭%) নারীর নামে এবং ২৪ শতাংশ নামের সঙ্গে যুক্ত ‘আক্তার’ শব্দ। যেমন– দিয়া আক্তার, রিয়া আক্তার, লিমা আক্তার, মিসা আক্তার ইত্যাদি। একইভাবে পুরুষ প্রোফাইলের ১৬ শতাংশের শেষ নাম ‘আহমেদ’। নারী-পুরুষ দুই ধরনের অ্যাকাউন্টের ৯০ শতাংশ নামই দুই শব্দের। নারীদের নামে খোলা অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রেও একই প্রোফাইল ছবি ভিন্ন ভিন্ন অ্যাকাউন্টে ব্যবহার হয়েছে।
বট নেটওয়ার্ক সাধারণত রাজনৈতিক পোস্টে মন্তব্য করে এবং ফেসবুক পোস্টে নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক কি-ওয়ার্ড বা শব্দ পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু কখনও কখনও তাদেরও ভুল হয়। যেমন হয়েছে ‘ইসি’ (নির্বাচন কমিশন) শব্দের ক্ষেত্রে। বিডি নিউজের ওই প্রতিবেদনের সারাংশে মেশিন আইডেন্টিফিকেশন কোড বা এমআইসি থাকায়, সেখানে তারা শতাধিক মন্তব্য করে।
আনলকড ১ হাজার ১২৪টি প্রোফাইলের মধ্যে ৮৫ শতাংশের অ্যাবাউটে পরিচিতি তথ্য নেই। ৯৩ শতাংশের ক্ষেত্রে প্রোফাইল ছবি, কাভার ফটো ছাড়া অন্য কোনো পোস্ট নেই। প্রায় অর্ধেক (৪৯ শতাংশ) প্রোফাইলে বন্ধুর দেখা যায় না এবং ৪৫ শতাংশ প্রোফাইলে বন্ধুর সংখ্যা ২০০-এর নিচে। মন্তব্য করার সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মন্তব্যগুলো করা হয়েছে দুই ঘণ্টার মধ্যে।
ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ফিলিপ মেরিল কলেজ অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইনফরমেশন স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক ড. নাঈমুল হাসান বলেন, ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানের ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছে, এখানে কম্পিউটেশনাল টুলের ব্যবহার হয়েছে।
গবেষণা বলছে, বট নেটওয়ার্কের বিস্তার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্ভুল তথ্য ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। জার্নাল অব ডেমোক্রেসিতে (২০১৬) উলি এবং হাওয়ার্ডের প্রকাশিত আরেক গবেষণায় বলা হয়, বট নেটওয়ার্ক অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি দমন করে নির্দিষ্ট কিছু দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যকার আলাপ-আলোচনাকে বিকৃত করতে পারে। এর ফলে মিথ্যা ধারণা তৈরি, জনমতের মেরূকরণ এবং শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়।