বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন কবি জাতীয় কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি এবং মানবতার কবি। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তার অসংখ্য গানে ও কবিতায় দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। যিনি দেশপ্রেমিক তিনি মানব প্রেমিকও বটে। দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম একে অন্যের পরিপূরক। কবির দেশাত্মবোধক রচনায় একই সঙ্গে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম উভয়েরই প্রকাশ ঘটেছে। দেশপ্রেমের সঙ্গে মনুষ্যত্বের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কবি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, মনুষ্যত্বের উন্মেষ না ঘটলে দেশপ্রেম অর্থহীন।
কবির জন্ম পরাধীন ভারতবর্ষে। বুঝতে শেখার পর থেকেই তিনি তার চারপাশে স্বদেশি আন্দোলন দেখেছেন। শত বিপ্লবীদের আত্মাহুতি প্রত্যক্ষ করেছেন। যৌবনে তিনি বিশ্বাস করেছেন গান্ধির অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে নয় বরং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আসবে। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় তিনি সরাসরি গান্ধির অহিংস নীতির বিরোধিতা করেছেন। তিনি লিখেছেন,
‘এল কোটি টাকা এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারী সমাজ।
যার বুক হতে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি বাঘ খাও হে ঘাস।
হেরিনুর জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ।’
কবি গান্ধির সুতা কাটারও বিরোধিতা করেছেন এভাবে, ‘জাগোরে জোয়ান। বাত ধরে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি।’
কবি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে আহ্বান করেছেন। তিনি জাতপাত ভুলে দেশমাতৃকার মুাক্তির সংগ্রামে সকলকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর পরিচয় পাওয়া যায় তার কান্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায়।
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয় জানে না সন্তরণ,
কান্ডারী! আজি দেখিব তোমার মাতৃমুক্তির পণ।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী, বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
দেশের প্রতি কবির ছিলো গভীর ভালোবাসা। দেশমাতৃকার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিলো তার সারা হৃদয়জুড়ে এবং তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই আসবে সেই মুক্তি। তাইতো তিনি লিখেছেন,
‘ঐ গঙ্গায় ডুবিছে ভারতের দিবাকর,
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’
ব্রিটিশদের সাতে যারা আপোসের রাজনীতি করেছেন কবি তাদের প্রচণ্ড ঘৃণা করেছেন। ব্রিটিশদের তিনি শোষক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মসনদে আঘাত হানার আহ্বান জানিয়েছেন। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে কবির প্রবল প্রতিবাদের সুর শোনা যায় তার গানে। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী।’
তবে কবির কণ্ঠে প্রত্যাশার বানীও শোনা যায়। সন্ধ্যা কাব্যের ‘অন্ধ স্বদেশ দেবতা’ কবিতায় তিনি লিখেছেন,
‘ওরে ওঠ ত্বরা করি
তোদের রক্তে রাঙা উষা আসে, পোহাইছে বিভাবরী।’
কালো চামড়ার মানুষের প্রতি শেতাঙ্গদের অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইশ্বরের কাছে তিনি অভিযোগ করেছেন তার ‘ফরিয়াদ’ কবিতায়।
‘সাদা রবে সবাকার টুটি টিপে, এনহে তব বিধান,
সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান,
ভগবান ভগবান।’
দীর্ঘ পরাধিনতার গ্লানিতে দেশের মানুষ যখন কিছুটা ম্রিয়মান তখন কবি তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে লিখেছেন,
‘বল বীর।
চির উন্নত মম শির,
শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর।’
কবির জন্ম হয়েছিলো এমন একটা সময়ে যখন দেশের মানুষ ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ছিলেন আন্দোলনরত। দেশবাসীর চেতনায় তখন স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, স্বাধীনতা, বিপ্লব, স্বরাজ ইত্যাদি ভাবধারা ছিলো জাগ্রত। কবি এগুলোর মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠেছেন। তাই তার লেখায় স্বদেশপ্রেম মহিমান্বিত হয়ে ফুটে উঠেছে। অগ্নিবীনা, বিষের বাঁশি, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফনিমনসা, জিঞ্জীর, সন্ধ্যা, প্রলয় শিখা প্রভৃতি কাব্যে কবির স্বদেশপ্রেমের উজ্জল দৃষ্টান্ত প্রতিভাত হয়েছে। কবির কাব্যে স্বদেশপ্রেমের যে বাণী উচ্চারিত হয়েছে তা যৌবনদীপ্ত, পৌরষদীপ্ত, তেজময়ী এবং জ্বালাময়ী। তাইতো তাকে বার বার ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। তাকে জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছে।
কবি নজরুল বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য ইসলামী ঐতিহ্য ও বীরত্বপূর্ণ ঘটনা তার কাব্যে তুলে ধরেছেন। যেমন ‘কামাল পাশা’ কবিতা, যেখানে তিনি তুর্কি বীর কামালের বীরত্ব, স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনার কথা বলেছেন। এতে বাঙালি মুসলমানরা দেশপ্রেমের দীক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়েছে। মুসলমানদের স্বদেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করতে তিনি ‘মোহররম’ কবিতায় আরো বলেছেন,
‘ফিরে এলো আজ সেই মোহররম মাহিনা
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহিনা।
জাগো ওঠ মুসলিম, হাঁকো হাইদরী হাঁক।
শহিদের দিনে সব লালে লাল হয়ে যাক।’
দেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন কবি তাদের মৃত্যুঞ্জয়ী শহিদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি তাদের জন্য অশ্রুপাত করতে চান না। তাই তিনি বলেছেন, ‘মৃত্যু এরা জয় করেছে, কান্না কিসের’?
ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আনতে যে ধ্বংস হবে কবি তার পরেই সুন্দর একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় বলেছেন, ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?
প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন।
আসছে নবীন-জীবন হারা অসুন্দরে করতে ছেদন!
তাই যে এমন কেশে-বেশে
প্রলয় বয়েও আনছে হেসে-
মধুর হেসে!
ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর!’
দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে যদি মৃত্যু হয়, কবি সে মৃত্যুকে অমৃতের উৎস বলে অভিহিত করেছেন। তাই তিনি বলেছেন,
‘জাগো এ দেশের দুর্বার যত দুরন্ত যৌবন।
আগুনের ফুল-সুরভি এনেছে চৈতালী সমীরণ।
সেই সুরভির নেশায় জেগেছে অঙ্গে অঙ্গে তেজ
রক্তের রঙে রঙে রাঙায় ভুবন ভৈরব রংরেজ।
জাগো অনিদ্র অভয় মুক্ত মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ,
তোমাদের পদধ্বনি শুনি হোক অভিনব উত্থান
পরাধীন শৃঙ্খল কবলিত পতিত এ ভারতের।
এতো যৌবন রণ-রস-ঘন হাতে লয়ে শমেশর।’
এমনি করে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যে তার দেশপ্রেম মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবির ৪৭তম প্রয়াণ দিবসে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।