নভেম্বর। ১৯৪৯। পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে সেন্ট গ্রেগরীজ হাইস্কুলে শুরু। প্রথম পাঁচ বছর সেন্ট গ্রেগরীজ কলেজ নামেই পরিচিতি। কলা ও বাণিজ্য বিভাগে ১৯ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয় যাত্রা। তখন ক্লাস শুরু হতো সকাল সাড়ে সাতটায়। শেষ হতো দশটায়। এরপরে হাইস্কুলের ক্লাস চলতো।
অতি অল্পদিনের মধ্যে ছাত্র সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে কলেজটি সেন্ট গ্রেগরীজ বিদ্যালয় থেকে মাত্র কয়েক শত গজ দূরে একটি আবাসিক ভবনে স্থানান্তরিত হয়।
১৯৫২-১৯৫৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে নটর ডেম কলেজে বিএ ক্লাস চালুর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন মেলে। ঠিক তার পরের শিক্ষাবর্ষেই প্রথম বিজ্ঞান শাখা শুরু হয়। জায়গার অভাবে ব্যাবহারিক ক্লাসগুলো তখন অনুষ্ঠিত হতো অস্থায়ী টিনের ঘরে।
নতুন ক্যাম্পাসে কলেজের গেট ও ক্যানটিনের মাঝখানের জায়গা মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কলেজের ছাত্ররা এই মাঠে ফুটবল ও বেসবল খেলতেন। অনেক সময় ফাদাররাও ছাত্রদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিতেন। সে যুগে বেসবল খেলার বেশ প্রচলন ছিলো। তাই ঢাকার শহরে অনেক বিখ্যাত বেসবল প্রতিযোগিতা এই মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
নতুন স্থানে ত্রিতলবিশিষ্ট নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হতে না হতেই ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে, জনাকীর্ণ পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজার ত্যাগ করে কলেজটি মতিঝিল এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। অধ্যাপক ফাদারদের থাকার ব্যবস্থা হয় নতুন ভবনের তৃতীয় তলায়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুলাই নতুন ভবনে প্রথম ক্লাস শুরু হয়।
প্রতিবছরই কলেজের ছাত্রসংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়াতে কলেজে আবার স্থানাভাব দেখা দেয় এবং আর একটি নতুন ভবন তৈরি অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাই মূল কলেজ ভবনের উত্তরে একটি চারতলা দালান তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয় এবং ফাদার মার্টিনের তত্ত্বাবধানে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে তার নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়।
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কলেজের মূল ভবনের দক্ষিণ পাশে যাজক-অধ্যাপকদের আবাসিক ভবন ম্যাথিস হাউস নির্মিত হয়। ফাদার মাইকেল ম্যাথিস ছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গে পবিত্র ক্রুশ ফাদারদের দ্বারা পরিচালিত মিশনারি কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। তারই সম্মানে এই যাজক-ভবনের নামকরণ হয় ম্যাথিস হাউস।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের মধ্যে অস্থিরতা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। নটর ডেম কলেজে তখন কোনো ধরনের ছাত্র ইউনিয়ন ছিলো না। পড়াশোনা ছাড়াও খেলাধুলা, ক্লাব ও অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমে ছাত্রদের ব্যস্ত রাখা হতো। ক্লাবের মডারেটর ও ছাত্রদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিলো এই কলেজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্রমে ক্রমে রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় নটর ডেম কলেজেও ছাত্র ইউনিয়ন শুরু করার জন্য অধ্যক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি হতে থাকে।
কলেজ কর্তৃপক্ষ তখন সিদ্ধান্ত নেয়, যথার্থ পরিচালনা পেলে ইউনিয়ন হয়তো ছাত্রদের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে। তাই ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সুস্পষ্ট নীতিমালা বা সংবিধান মাফিক ইউনিয়ন গঠিত হয় এবং ছাত্রদের ওপর কলেজের কিছু কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইউনিয়নের কর্মকাণ্ড আশানুরূপ হয়নি। শুরু থেকেই অন্যান্য কলেজের ন্যায় এ কলেজেও নানা ধ্বংসাত্মক প্রবণতা দেখা দেয়।১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আইয়ুব খানের পতন ঘটানোর জন্য আন্দোলন যতোই তীব্র হতে থাকে, সুষ্ঠুভাবে কলেজ পরিচালনার কাজও ততোই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এভাবে ১৯৭০-৭১-এ স্বাধীনতা আন্দোলন অধিকতর জোরদার হয়। অতঃপর স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ছাত্রদেরে অনুপস্থিতির কারণে কলেজ বন্ধ থাকে। কলেজের অধিকাংশ ছাত্রই কোনো না কোনোভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ কয়েক সপ্তাহে জাতিসংঘের ৪৪ জন কর্মকর্তা নটর ডেম কলেজকেই তাদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং কলেজটি তখন রেডক্রস-জাতিসংঘের সুরক্ষিত স্থান হয়ে উঠেছিলো।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী বছরে সরকার সকল ছাত্রছাত্রীকে কোনো পরীক্ষা না নিয়েই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ বলে ঘোষণা দেয়। সে বছর নটর ডেম কলেজে বিজ্ঞান শাখায় দু’টির বদলে ৯টি গ্রুপ খুলতে হয়। এ কলেজে শুরু থেকেই শিক্ষার মাধ্যম ছিলো ইংরেজি। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সরকার স্কুল-কলেজে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে। ফাদার বেনাস তখন দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার একটি কোর্স চালু করেন। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এমন যে কোনো ছাত্র বা ছাত্রী, পুরুষ বা মহিলা, এই কোর্সে যোগ দিতে পারতেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কলেজের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হতে থাকে। প্রতিটি শাখায় ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় বিজ্ঞান শাখায়।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন নটর ডেম কলেজকে প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যায়। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে হাইস্কুল থেকে পরীক্ষা না দিয়েই উত্তীর্ণ ঘোষিত ছাত্রদের মধ্যে যারা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, এক বছর ‘অধ্যয়নের’ পর তারা বুঝতে পরেন, কলেজ পরীক্ষায় পাস করতে পারবেন না এবং বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি পাবেন না। তখন তারা কলেজ ইউনিয়নের সহায়তায় সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত নেন এবং বোর্ডের পরীক্ষা দেয়ার অনুমোদন দাবি করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ইউনিয়ন নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়-পুলিশ বাহিনীকে ডেকে আনা হয়, কিন্তু রাজনৈতিক চাপের দরুন তারা বিদায় নেন। বেশ কিছু দুর্বৃত্ত ক্যাম্পাসে ঢুকে লুটপাট করেন। দরজা জানালা ও আসবাবপত্র তছনছ করেন। তখন ভালো ছাত্ররা ইউনিয়ন নির্বাচন বর্জন করেন। নটর ডেম কলেজে নয় বছরব্যাপী স্থায়ী ছাত্র রাজনীতির অবসান ঘটে।
বিগত ৭৫ বছরের ইতিহাসে নটর ডেম কলেজ এদেশে শিক্ষা বিস্তারের জন্য আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। তিন তিনবার সরকারের কাছ থেকে
জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে (১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৭)। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে পদার্থবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক সুশান্ত কুমার সরকারকে শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে কলেজে ভর্তির জন্য অত্যধিক চাপ থাকাতে ছাত্র বাছাই করার সুনিদিষ্ট পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়।
বর্তমানে (২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ) কলেজে ফাদার হ্যারিংটন ভবন, ফাদার গাঙ্গুলী ভবন, ফাদার টিম ভবন ও ফাদার পিশোতো ভবন-এই চারটি ভবনে ৭ হাজারেরও অধিক ছাত্র ক্লাস করেন। এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে বিজ্ঞান বিভাগে ৩৪টি গ্রুপ (ইংরেজি মাধ্যমের ৬টিসহ), মানবিক বিভাগে ৮টি গ্রুপ, বাণিজ্য বিভাগে ১২টি গ্রুপ ও ডিগ্রি বিএসএস-এ ৪টি বর্ষের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। গ্রুপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষক সংখ্যাও ৯৬ জনে উন্নীত হয়েছে। এর ফলে ক্লাসরুমের পরিবেশ শিক্ষাবান্ধব হয়ে উঠেছে।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ ডিসেম্বর নটর ডেম কলেজের ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায় সংযোজিত হয়। এদিন মহামান্য পোপ ফ্রান্সিস কলেজ প্রাঙ্গণে এসে দু'টি নতুন ভবনের নামফলক উন্মোচন করেন। ড. ফা. হেমন্ত দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই পরিবেশবিষয়ক দু'টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন যা তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার সাক্ষ্য দেয়। সম্মেলন দু'টি কয়েকশ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অত্যন্ত সফল ও প্রাণবন্ত ছিলো এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছে।
কলেজের সহশিক্ষা কার্যক্রমকে আরো বেগবান ও সম্প্রসারিত করার জন্য ক্লাব সংখ্যা ২৪টিতে উন্নীত করা হয়েছে। শুধু কলেজ অভ্যন্তরে নয়, পাঠ্যপুস্তক বহির্ভূত এ কার্যক্রমকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে দিতে সচল করা হয়েছে আউট রিচ প্রোগ্রাম। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের বাঞ্ছিত মূল্যবোধ গঠনে নটর ডেম কলেজে প্রতি মাসে একটি করে নৈতিক শিক্ষা ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ, এতে ছাত্র-শিক্ষক যেমন একে-অপরকে বোঝার সুযোগ লাভ করেন, তেমনি শিক্ষকদের সান্নিধ্যে থেকে নিজেদের আচরণের ত্রুটি-বিচ্যুতি- সীমাবদ্ধতাগুলো জেনে নিজেদের নৈতিকতাকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ পান।
কলেজের শুরু থেকেই ছাত্রদের পরীক্ষার ফলাফল সার্বিকভাবে প্রায় সব সময়ই সন্তোষজনক ছিলো। কালের আবর্তে নটর ডেম কলেজ বাংলাদেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে।
(কলেজ প্রতিষ্ঠার ৭৪ বছর পূর্তি উৎসবে প্রকাশিত ‘নটর ডেম কলেজ, ঢাকার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ অবলম্বনে। লেখক নটর ডেম কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী)
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।