উৎপাদনমূখী স্বনির্ভর, নৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে নতুন কারিকুলাম। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ঢেলে সাজানো হয়েছে একে। এ উদ্দেশে প্রাক প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে মোট ১০টি যোগ্যতা যেগুলোকে বলা হচ্ছে মূল যোগ্যতা বা Core Competency. এসব যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে যেতে হবে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আর এ প্রক্রিয়ার সূচনা হবে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। আর সেভাবেই প্রণয়ন করা হয়েছে পাঠ্যপুস্তক। এতে সন্নিবেশিত হয়েছে বিভিন্ন কাজ এবং অনুশীলন। এসব কাজ এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী এগিয়ে যাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে এসব কাজের নির্দেশনা দিবেন বিষয় শিক্ষক। সেজন্যও প্রণয়ন করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন সম্বলিত শিক্ষক সহায়িকা। অর্থাৎ শিক্ষক তার মনগড়া পদ্ধতিতে কিংবা নিজের মতো করে সেশন পরিচালনা করতে পারবেন না।
ইতোমধ্যে একধাপে নতুন কারিকুলাম বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে শিক্ষকগণকে। দ্বিতীয় ধাপের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ হবে। এমনটিই আভাস ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এই শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকমহলে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এই পদ্ধতির দুর্বোধ্যতা এবং অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ইতোমধ্যে অভিভাবকদেরকে মিসগাইড করছে বিশেষ কয়েকটি শ্রেণি। এতদসত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ডাইনামিক শিক্ষক। বাস্তবায়নের মূল কাজটি যেহেতু শিক্ষকরাই করবেন সেহেতু শিক্ষকদের মধ্যে কোনোরূপ অস্পষ্টতা, ভুল তথ্য ধারণ করার অবকাশ নেই। শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার পূর্বে প্রস্তুতি নিতে অনীহা কিংবা অপারগ মনোভাব থাকাও সমীচীন নয়।
আমাদের দেশে শিক্ষক কিংবা অন্যান্য নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর কর্মতৎপরতা, উদ্যম, সহপাঠ্যক্রমিক দক্ষতা, সততা, মূল্যবোধ ইত্যাদি মূল্যায়নের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে শুধুমাত্র জ্ঞান বা তথ্য মেমোরাইজ করার দক্ষতা দেখিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করার সুযোগ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব পড়ুয়া ছেলেটি ভালো রেজাল্ট করলে খুব মেধাবী বলে পরিচিতি পায় আমাদের দেশে। আবার অল্প পড়াশোনা করেও মেমরিতে তথ্য ধারণ করে একাডেমিক পরীক্ষায় যারা ভালো রেজাল্ট করে তাদেরকেও মেধাবী বলে বিবেচনা করা হয়। মূলকথা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টই তাকে এই সুনামের অধিকারী করে। কিন্তু এই ভালো রেজাল্টের পিছনে কী কী নিয়ামক কাজ করেছে তা মূখ্য হয় না। একাডেমিক পরীক্ষার পাশাপাশি নিয়োগ পরীক্ষায়ও মেমোরি বা স্মৃতি থেকে তথ্য ডেলিভারি দিতে পারলেই চাকরির জন্য সে যোগ্য বলে ধরা হয়। প্রতিটি মানুষই সম্ভবত তার অভ্যাসগত কাজটিকে ভালোবেসে ফেলে, আপন করে নেয়। মানুষ তার এই অভ্যাসগত কাজটিকে যৌক্তিক ভাবতে পছন্দ করে। তাই যে শিক্ষার্থী পড়ুয়া হয় সে সেটিকে প্রাধান্য দেয়। যে শিক্ষার্থী ভালো রেজাল্টের পেছনে দৌড়ান তিনিও মনে করেন এটিই হওয়া উচিত। একজন শিক্ষার্থীর পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য গুণাবলী ও দক্ষতাও যে দরকার তা তিনি বিশ্বাস করতে চান না। আবার যে শিক্ষার্থী খেলাধুলায় পারদর্শী তিনি ভাবেন খেলাধুলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক এভাবেই যে বক্তৃতা, বিতর্ক, সংগীত ইত্যাদিতে আনন্দ পান, চর্চা করেন তিনি ভাবেন, এটিই মানুষের জীবনে খুব দরকার। এ কারণে একজন শিক্ষার্থী যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তখন তিনি তার অতীতে করে আসা কাজটিকেই লালন করেন, ভালোবাসেন। সুযোগ পেলেই তার সেই পারদর্শিতা প্রদর্শনের চেষ্টা করেন।
নতুন কারিকুলামে শুধু একই ধরনের কাজ করা, একই জাতীয় পারদর্শিতা অর্জনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বরং এতে বিভিন্ন বিষয়ে কাজের ধরন আলাদা, বৈচিত্র্যময়। এতে যেমন মুখস্থ করার বিষয় আছে তেমনি আছে, খেলাধুলা, সৃজনশীলতা, কর্মদক্ষতা অর্জন ও বিকাশের সুযোগ। আছে পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখন অর্জন এবং প্রতিটি কাঠামোতে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার সক্ষমতা অর্জনের জ্ঞান ও দক্ষতার সন্নিবেশ। শিক্ষার্থীর পঠিতব্য বিষয় তার জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে কাজে লাগে তা সনাক্ত করা হয়েছে। ফলে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কথা হলো, নতুন কারিকুলাম যাদের হাতে উঠেছে অর্থাৎ যাদের হাত দিয়ে এটি বাস্তবায়িত হবে সঙ্গত কারণেই তাদেরকেও হতে হবে বৈচিত্র্যময় জ্ঞানের অধিকারী। তাদেরও থাকতে হবে হরেক রকম কাজের দক্ষতা। সেইসঙ্গে কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও কাজের মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করার আগ্রহ। যদি পূর্ব থেকেই শিক্ষকদের এই আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে তারা এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করবেন সন্দেহ নেই। কিন্তু যারা শিক্ষাজীবনে কখনো পড়াশোনার বাইরে অন্য কাজে নিজেকে জড়াননি তারা কতো দ্রুত নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে পারবেন সেটি দেখার বিষয়। তারা যত দ্রুত পুরাতন খোলস ভেঙে বেরুতে পারবেন ততো দ্রুত নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়িত হবে। কোনো চাপে বা ভয়ে নয় বরং স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করলে সফলতা সহজে আসে। তাই শিক্ষকরা নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে, নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রস্তুতি নিয়ে শ্রেণিতে গমন করে আন্তরিকতার সঙ্গে সেশন পরিচালনা করলে এর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে। অতএব, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষককে হতে হবে ডাইনামিক-এ কথা বলা বাহুল্য হবে না।
লেখক: মাস্টার ট্রেইনার, উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার, হবিগঞ্জ
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।