নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৫ সালে পুরোপুরি চালু হলে শিক্ষার্থীদের আর আলাদা করে কোচিং করার ‘প্রয়োজন পড়বে না’ বলে জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তার বক্তব্যের দেড় মাসের মাথায় রাজধানীর বেইলি রোডে নতুন শিক্ষাক্রমে কোচিংয়ের প্রচারপত্র বিলি করছে ‘রিলায়েন্স এডুকেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় গত ৬ নভেম্বর চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর প্রথমদিনে কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে মন্ত্রী আরো বলেছিলেন, ২০২৩ সাল অর্থাৎ আগামী বছর থেকে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে, পরের বছর অষ্টম-নবমে এবং ২০২৫ সালে দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হচ্ছে। ২০২৫ সালের পর থেকে আমরা সব ক্লাসে নতুন শিক্ষাক্রমে যেতে পারব। তখন যে ধরনের শিক্ষাক্রম হবে, সেখানে শেখানোর পদ্ধতি যে রকম হবে, তাতে আর কোচিংয়ের প্রয়োজন থাকবে না। সেখানে এসএসসি, এইচএসসির কোচিংয়ের প্রয়োজন হবে না। প্রি-প্রাইমারি থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত ২০২৫ সালের পরে আর কোচিংয়ের প্রয়োজন হবে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শিক্ষামন্ত্রী কিংবা শিক্ষা প্রশাসন থেকে যতই বলা হোক, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ের প্রয়োজন পড়বে না ততই কোচিং ব্যবসায়ীরা তাদের ‘নয়া ধান্ধা’ নিয়ে মাঠে নামছে। নিত্যনতুন ভাষা দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে রাজধানীর অলিগলির দেয়াল ভরিয়ে দিয়েছে। রাজধানীর বেইলি রোডের বিলি করা প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, ‘আপনি কি আপনার সন্তানকে মেধাবী করে গড়ে তুলতে চান? ২০২৩-এ প্রণীত নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার আলোকে শুরু হতে যাচ্ছে একাডেমিক কোচিং প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি রিলায়েন্স এডুকেশন। রাজধানীর পীরজঙ্গি মাজার শাখা, খিলগাঁও শাখা এবং মুগদা শাখায় তাদের কার্যক্রম চলছে।’ প্রচারপত্রে থাকা রাজু স্যারের সঙ্গে কথা বলে ।
প্রতিবেদকের পরিচয় গোপন করে রাজু স্যারের কাছে তাদের কোচিংয়ে ভর্তিসহ নানা তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি এবং শিক্ষার্থীর পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে ৩ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে।
এরপর প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকা করে দিতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে কোনো কোচিংয়ের প্রয়োজন পড়বে না, স্কুলেই হাতে-কলমে সব শিক্ষা হবে, তবু কোচিং কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রাজু স্যার বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে আচরণসহ নৈতিক শিক্ষা এবং অন্য অনেক বিষয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নাম্বার দেবেন। এতে স্বজনপ্রীতি হতে পারে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে স্কুলের শিক্ষকরা কতটুকু পড়াতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এজন্য আমাদের কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলে শিক্ষকরা পড়াতে না পারলেও আমরা শিক্ষার্থীদের তৈরি করে দেব। এতে স্কুলে শিক্ষকরা স্বজনপ্রীতি করেও আমাদের কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের ঠকাতে পারবেন না।কোচিংবাজদের এমন বিজ্ঞাপনের তীব্র বিরোধিতা করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেছেন, কোচিং নির্ভরতা কমানোর জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত শিক্ষাব্যবস্থার নতুন শিক্ষাক্রম আগামী বছর থেকে আমাদের এখানে কার্যকর হতে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের কার্যক্রম হবে হাতে-কলমে। এখানে গাইডের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা চলবে না। তবু কেউ কেউ ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে কোচিং ব্যবসা চালু করতে পারেন। এই ব্যবসা বন্ধ করার জন্য প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি। এ ধরনের কোচিংয়ে ভর্তি না হওয়ার জন্য তিনি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ২০২৫ সালে সম্পূর্ণ নতুন পাঠক্রমে পড়বে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় একে ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শেখার মাধ্যমে পাঠ প্রক্রিয়াকে আনন্দময় করার উদ্যোগ’ বলছে। শিক্ষার্থীদের পাঠগ্রহণকে যুগোপযোগী, কার্যকর এবং আনন্দময় করতেই তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না রাখা, এসএসসির আগে পাবলিক পরীক্ষা না নেয়া, নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগভিত্তিক বিভাজন তুলে দেয়াসহ একগুচ্ছ পরিবর্তন আনা হয়েছে শিক্ষাক্রমে। চাপ কমাতে বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়নের আগে শিক্ষাবর্ষজুড়ে চলবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। বেশ কিছু বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ।
এর আগে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি সামনে রেখে তথ্যপ্রযুক্তিতে গুরুত্ব দিয়ে সৃজনশীল শিক্ষার প্রসারে ২০১২ সালে শিক্ষাক্রম তৈরি করেছিল সরকার। সে সময় নয়া শিক্ষাব্যবস্থার সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে বাজারে রাতারাতি নোট-গাইড বই যেমন বেরিয়েছিল তেমনি গজিয়ে উঠেছিল নয়া নয়া কোচিং সেন্টার। এবারও একইভাবে শুরু হয়েছে। কোচিংবাজদের রুখতে ২০১২ সালের ২০ জুন ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা ২০১২’ জারি করে সরকার। তবে এর ফলে কোচিং ব্যবসা আরও দানবীয় আকার নেয়। রাজধানীর শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন, মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের ঘোষণার কয়েকদিন পরই শিক্ষকরা তাদের কাছে পড়ার অর্থমূল্য (টিউশন ফি) বাড়িয়ে দেন। যা দশ বছর পর এসে আরো বেড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোচিং বন্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের ওই নীতিমালার কোনো কার্যকারিতা নেই। অভিভাবকরা বলছেন, আগে শিক্ষকরা কোচিংকে অবৈধ মনে করে কিছুটা রাখঢাক করতেন। কিন্তু এখন ভাবটা এমন যে, কোচিং ব্যবসা অপরাধের কিছু না। তাই টিউশন ফি বেশি দিতে হবে। এর মধ্যে যেসব শিক্ষকের কাছে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই কোচিং করতো তাদের আরও পোয়াবারো অবস্থা।
কোচিং ব্যবসার ঘোরতরবিরোধী জানিয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, কোচিং ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত সফলভাবে এদেশের সব অভিভাবককে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, স্কুল-কলেজের লেখাপড়া পরিপূর্ণ নয়। এর সঙ্গে যেভাবে হোক যতখানি সম্ভব কোচিংয়ের স্পর্শ থাকতে হবে। এখন অভিভাবকরা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তারা মনে করে যেহেতু সবার ছেলেমেয়ে কোচিং করছে, তাই যদি নিজের ছেলেমেয়েদের কোচিং করতে না দেয়া হয়, তাহলে কোনো এক ধরনের অপরাধ করা হয়ে যাবে। সেই অপরাধের কারণে তাদের ছেলেমেয়েদের কোনো একটা ক্ষতি হয়ে গেলে তারা কখনোই নিজেদের ক্ষমা করতে পারবে না। সেজন্য ভালো হচ্ছে না, মন্দ হচ্ছে সেটা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। নিজের ছেলেমেয়েদের চোখ বন্ধ করে কোচিং করতে পাঠায়। এ কোচিং করার কারণে তাদের ছেলেমেয়েদের জীবনে যে এতটুকু বিনোদনের সময় নেই, সেটি নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। নিজের সন্তানদের এভাবে নির্যাতন করার আর কোনো উদাহরণ আছে কিনা আমার জানা নেই।