একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ও সম্ভাবনাময়। ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রেখে একটি জাতিকে এগিয়ে যেতে হলে দক্ষ ও উন্নত মানবসম্পদ গঠনের বিকল্প নেই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিজেদেরকে মেলে ধরতে হলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, সমস্যার গভীরে গিয়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে চিন্তা করতে পারা এবং পরিকল্পিত দক্ষতা অর্জনে গুরুত্ব দিতে হয়। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে ও স্মার্ট নাগরিক তৈরি করতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কারিকুলামের প্রধান লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিখনের পরিবেশ তৈরি করা। তবে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন নিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বহুবিধ কৌতূহল কাজ করছে। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের অভিমত, নতুন শিক্ষাক্রম বিশ্বমানের ও পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য উত্তম। কিন্তু যোগ্যতাভিত্তিক এই নতুন শিক্ষাক্রম বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়ন কতোটা সম্ভব? কেনোনা কারিকুলাম তৈরি করা এক বিষয় আর বাস্তবায়নের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা ভিন্ন বিষয়। একটি কারিকুলাম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে নিম্নের পাঁচটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বরোপ করা আবশ্যক। পাঁচটি ক্ষেত্রের ওপর নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের সফলতা বা বিফলতা অনেকাংশে নির্ভর করছে।
১. শিক্ষক সংকট ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত: যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাক্রম চালু আছে এমন কয়েকটি দেশে ‘এনসিটিবি’র সমীক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের আদর্শ চিত্র উঠে এসেছে। যথা-সুইডেনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:১২, অস্ট্রেলিয়ায় ১:৯, ইন্দোনেশিয়ায় ১:১৫, ফিনল্যান্ডে ১:১৩, থাইল্যান্ডে ১:২৪, ভারতে (প্রদেশভিত্তিক) ১:২৮। (অনুপাতের তথ্যগুলো আগের হওয়ায় অনুপাত কমবেশি হতে পারে।) শিক্ষক-শিক্ষার্থী স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ অনুপাত ১:৩০। বাংলাদেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে এখন ৩৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ব্যবধান আরো অনেক বেশি। এ ছাড়া বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। কোনো বিদ্যালয়ে ৩০০ শিক্ষার্থী আবার কোনো বিদ্যালয়ে ২ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে একটি শ্রেণিতে ৩ থেকে ৫টি শাখাও রয়েছে। এক একটি শাখায় প্রায় ৬০ জনের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। কিন্তু সে তুলনায় পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। অনেক বিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া খণ্ডকালীন শিক্ষকদের নিয়োগ, বিষয়ভিত্তিক ট্রেনিং, বেতন প্রাপ্তি নিয়েও নানা সমস্যা রয়েছে। ফলে মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষার্থী নিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নসহ শিখন-শেখানো কার্যাবলি পরিচালনা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। শিক্ষক সংকট দূর না করলে এবং বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষার্থীর ভারসাম্যহীনতা না কমলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব তা সময়-ই বলবে।
২. শিক্ষকদের নিম্নমানের বেতন-ভাতা: বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯৫ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (সাধারণ, মাদরাসা ও কারিগরি) বেসরকারি। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন (বি.এড ডিগ্রিবিহীন) সহকারী শিক্ষক নিয়োগের শুরুতে সর্বসাকুল্যে বর্তমানে ১২ হাজার ৭৫০ টাকা বেতন পান (বিশেষ প্রণোদনা ১ হাজার বাদে)। বর্তমান বাস্তবতায় একজন শিক্ষক পরিবার নিয়ে এই স্বল্প বেতন কীভাবে সংসার চালাবেন তা কেউ ভেবে দেখে না। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এতো কম টাকায় শিক্ষক পাওয়া যায় না। বেতন-ভাতা নিম্নমানের হওয়ায় মেধাবীরা এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান না। হাজার হাজার সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিজ জেলার বাইরে বা অপছন্দের জেলায় চাকরি হয়েছে। প্রকৃত বদলি সিস্টেম বন্ধ রেখে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের স্বাভাবিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই যৎসামান্য বেতনে নিজে কীভাবে চলবেন আর পরিবার-ই কীভাবে চালাবেন? নতুন কারিকুলামে শিক্ষককে অনেক বেশি প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে, মূল্যায়ন তথ্য ব্যবস্থাপনায় শ্রম দিতে হচ্ছে, কম্পিউটারভিত্তিক অনেক কাজ করতে হচ্ছে। দক্ষ ও পরিশ্রমী শিক্ষকেরা মুখ বুজে সবকিছু সামলে নিচ্ছেন। মানসম্মত শিক্ষার কথা বলে আমরা রাত-দিন গলা ফাটায়, অথচ যারা মানসম্মত শিক্ষা দেবেন তাদের মানসম্মত বেতনের নিয়ে আলোচনা হয় না। ধার করা কারিকুলাম ঘষে-মেজে বাস্তবায়নও সম্ভব হতো যদি শিক্ষকদের পেটে ক্ষুধা আর, মনের কষ্ট দূর করা যেতো।
৩. অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা না থাকা: অনেক অভিভাবককে বলতে শুনেছি, শিক্ষা নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, নতুন কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় সক্রিয় রাখতে ভূমিকা রাখছে। আগের মতো গাইডের তৈরি করা উত্তর মুখস্থ করতে হচ্ছে না। হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণ ভাবনা, সহযোগিতার মনোভাব ও প্রশ্ন করার মনোভাব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নতুন কারিকুলাম নিয়ে বেশিরভাগ অভিভাবকদের মনে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। অনেকে বলতে শুনেছি, সন্তানরা এখন বাসায় পড়ালেখা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। শুধু হাতে-কলমে করে দেখানো শিখন প্রক্রিয়ায় এক ধরনের সমস্যাও আছে। জ্ঞানের ভিত মজবুত না হলে দক্ষতা তৈরি হওয়ার মধ্যে ফারাক থেকে যাচ্ছে। অনেকে মনে করেন, যেহেতু পাস-ফেল নেই এবং বছর শেষে নতুন শ্রেণিতে রোল পরিবর্তন হচ্ছে না সেহেতু শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। অভিভাবকরা যদি লেখাপড়ার নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত না হন তাহলে তিনি তার সন্তানকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে পারবেন না-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সন্তানের মানসম্মত লেখাপড়ার ক্ষেত্রে পিতামাতা বা পরিবারের সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মূল্যায়ন নিয়ে অনেক অভিভাবক এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি। শিক্ষার নতুন পদ্ধতি বিষয়ে অভিভাবকদের সরাসরি সম্পৃক্ত করার কথা থাকলেও মাঠপর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে। অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা ছাড়া নতুন কারিকুলাম পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন কি সম্ভব? inside-ad]
৪. মূল্যায়নে হ-য-ব-র-ল: মাধ্যমিক পর্যায়ে সারা বাংলাদেশে একসঙ্গে একযোগে একই সময়ে একই বিষয়ের মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে-এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু ‘ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন-২০২৪’- এ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেক নির্দেশনা নানা কারণে পরিপূর্ণভাবে পালন করা সম্ভবপর হচ্ছে না। মূল্যায়নে ২০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে একজন শিক্ষক একটি কক্ষে মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা থাকলে যেসব বিদ্যালয়ে ১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ স্বল্পতায় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন কি সম্ভব? নৈপুণ্য অ্যাপসে পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় প্রশ্নের জন্য রাত জেগে অপেক্ষা ও প্রশ্ন ছাপাতে হচ্ছে। সেটাতেও সমস্যা ছিলো না। সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, ষাণ্মাসিক মূল্যায়নের প্রশ্ন আগের দিন রাতে ইউটিউবে ফাঁস হয়ে যাওয়া। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ইউটিউবের ফাঁস করা প্রশ্নের আশায় বসে থাকে। অনেকে আবার কিছু কিছু প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর খাতায় লিখে নিয়ে এসে মুখস্থ করে। এমন কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নেই যিনি ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপসের সার্ভার জটিলতায় ভোগান্তি পোহাননি। ভোগান্তি আর নৈপুণ্য অ্যাপস যেনো সমসূত্রে গাঁথা। মূলত নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন হয় না, মূল্যায়ন হয় নির্দিষ্ট কাজের পারদর্শিতার ভিত্তিতে। একজন শিক্ষককে শিখনকালীন, আচরণিক, ষাণ্মাসিক সামস্টিক ও বার্ষিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শুধু একটি বিষয়ে একজন শিক্ষার্থীর শতাধিক পারদর্শিতার সূচক ইনপুট দিতে হয় এবং হচ্ছে। মুল্যায়ন তথ্য যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করে দিনের পর দিন ধরে এই সকল তথ্য ইনপুট দিতে হয়। যা ব্যাপক পরিশ্রমের কাজ। যেহেতু নৈপুণ্য অ্যাপস-এ প্রতি মাসে দেশের দুই কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) মূল্যায়ন তথ্য হালনাগাদ করতে হয় সেহেতু এই অ্যাপসে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করার প্রতি অতি বেশি গুরুত্বরোপ করার দরকার ছিলো। যেহেতু ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপস-এ প্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থীর ফলাফল তৈরি হবে সেহেতু এসএসসি ও এইচএসসি পাবলিক পরীক্ষার সার্ভার থেকেও এটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর অভিযোগ ষাণ্মাসিক বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়নে যেহেতু বই থেকে খুব কম তথ্য দেয়া হচ্ছে সেহেতু মূল্যায়নের আগের কয়েকদিন তারা বই থেকে ঠিক কী পড়বেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এ ব্যাপারে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে।
৫. পারিপার্শ্বিক প্রভাব: নতুন কারিকুলামে কোচিং ও গাইড বইয়ের দরকার পড়ে না। বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। গাইউ থেকে ষাণ্মাসিক মূল্যায়নে কিছু আসছে না। এটা ঠিক, কোচিং ও গাইড শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করে তোলে। শিক্ষার্থীরা শুধু বই থেকে শেখেন না। বাইরের পরিবেশ থেকেও শেখেন। পরিবার, চারপাশের চলমান দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহ, অন্যের আচরণ শিক্ষার্থীর চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলে। বইয়ের জ্ঞানের সঙ্গে যদি বাইরের বাস্তবের মিল খুঁজে না পায় তাহলে শিক্ষার্থীর মনে দ্বিধা তৈরি হয়। প্রশ্ন ফাঁস, সমাজের নানাবিধ বৈষম্য, অনিয়ম, অব্যবস্থা, চুরি করা, অপকর্ম করা, মিথ্যা কথা বলা, মানুষ ঠকানো, ক্ষমতার প্রভাব দেখানো, মানুষকে অবজ্ঞা করা, সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে মিথ্যায় রূপ দেয়া চারপাশের এসব সামাজিক সমস্যা শিশু শিক্ষার্থীদের মনে কোনো না কোনোভাবে দাগ কাটে। শিক্ষার্থীরা নিজের বাস্তব জীবন থেকে বেশি শিক্ষা লাভ করে। চারপাশে যদি খারাপ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় তখন সমাজে ভালো কোনো বিষয়কেও মানুষ আর ভালোভাবে গ্রহণ করতে ভয় পায়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সবার কাছে যতো গ্রহণযোগ্য ও ইতিবাচক হবে যেকোনো শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়ন করা ততো বেশি সহজ হবে। পরিবেশ তৈরি না করে বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত না করে শুধু ভালো কারিকুলাম দিলেও সুফল নাও মিলতে পারে।
উল্লিখিত পাঁচটি সমস্যার সমাধান করা না করার ওপর নতুন কারিকুলামের ভালো বা মন্দ নির্ভর করছে। পরীক্ষা আর ফলাফলের ওপর অভ্যস্ত হয়ে পড়া পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ নতুন কারিকুলামে ফেলা অসম্ভব নয়। তবে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্র তৈরি না হওয়ায় অনেক ভালো কারিকুলামও হয়তো আলোর মুখ দেখতে বেগ পেতে হয়। চালু হওয়া নতুন কারিকুলাম নিয়ে কথা বলতে বলতে হয়তো ততোদিনে আরো একটি নতুন কারিকুলাম বা পদ্ধতি আসার সময় হয়ে যাবে।
লেখক: শিক্ষক