নতুন শিক্ষাক্রমে মৌলিক দক্ষতা - দৈনিকশিক্ষা

নতুন শিক্ষাক্রমে মৌলিক দক্ষতা

তন্ময় কুমার হীরা |

শিক্ষা হচ্ছে জীবনের জন্য প্রস্তুতি। অথচ আমরা আমাদের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছি পরীক্ষার জন্য। ফলে শিক্ষার আসল অর্থ আমাদের কাছে যুগ যুগ ধরে অধরাই থেকে যাচ্ছে। আমাদের সন্তানেরা নিয়মিত স্কুল-কলেজে যাচ্ছে; পরীক্ষায় পাশ করছে। কিন্তু তাদের জীবনব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হয়নি। তাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসেনি। রান্নাকে তারা এখনো নারীর কাজ বলেই জানেন ও মানেন। রান্না ও কৃষি কাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকে তারা ছোট চোখে দেখেন।

পরীক্ষার প্রস্তুতিতে এগিয়ে থাকলেও জীবনের জন্য প্রস্তুতিতে আমরা প্রায় শূন্য। স্কুল কলেজ থেকে পাশ করেও আমরা প্রতিযোগিতার মনোভাব ত্যাগ করে সহযোগিতার মনোভাব তৈরি করতে পারি না, নারী-পুরুষের বৈষম্য বিলোপ করতে পারি না, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো বদল আনতে পারি না, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে পারি না, পরিবেশ-প্রকৃতি ও জীবজগতের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে পারি না, বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে সহ্য করতে পারি না, অন্যের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতাকে সম্মান করতে পারি না, সৎ ও অসাম্প্রদায়িক হতে পারি না, যুক্তিবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা তৈরি করতে পারি না, নিজের কাজ নিজে করতে চাই না, রাস্তাঘাট বিদ্যালয় ও বাড়ি পরিষ্কার করি না, যেখানে সেখানে থুথু ফেলি, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি, প্রবৃত্তির দাসত্ব করি এবং বাঁচার জন্য না খেয়ে আমরা খাওয়ার জন্য বাঁচি। অর্থাৎ আমাদের দেশে আদতে কোনো শিক্ষা হয় না। স্কুল কলেজের প্রায় সমস্ত আয়োজন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। অশিক্ষার এই ধারা ভেঙে নতুনত্বের প্রত্যাশায় নিয়ে আসা হয়েছে শিক্ষাক্রম-২০২১।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। জাতীয় সংসদ ভবন থেকে শুরু করে রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকান কিংবা বিদ্যালয়ের আঙিনা-সর্বত্রই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। নতুন শিক্ষাক্রমে ক্ষোভ ঝেড়েছেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী ও প্রবীণ অধ্যাপকেরাও। তবে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আপত্তি এসেছে শিক্ষার্থীর অভিভাবক বা আমজনতার কাছ থেকে। তারা এই নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে মাঠে নেমে ইতোমধ্যেই রীতিমতো ঝড় তুলেছেন। তারা নানা বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। এগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি শোনা যায় পুস্তকে ডিমভাজি-আলুভর্তা প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্তির নিন্দা।

গণমাধ্যমে এক অভিভাবককে বলতে শোনা যায়, ‘রান্না শেখার জন্য কিছুই লাগে না। আমি জীবনেও রান্না ঘরে যাইনি। কিন্তু বিয়ের পর তো কতো কিছুই পারি। রান্না তো  স্কুলে শিখতে হবে না’। সাধারণ মানুষ এভাবেই রান্নাকে সাধারণ কিছু মনে করে। কিন্তু রান্না কোনো সাধারণ বিষয় নয়। খাদ্য জীবনের প্রধান মৌলিক চাহিদা। রান্না জীবনের একটি মৌলিক দক্ষতা। খাদ্য আমাদের জীবনের প্রায় সবকিছু ঠিক করে দেয়। আমাদের শরীর-মন, আচার-আচরণ, বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে খাদ্য। তাই খাদ্য প্রস্তুত বা রান্না যেকোনোভাবে হলেই হয় না। তাকে হতে হয় জ্ঞানভিত্তিক। আমরা প্রথাগতভাবে যে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলেছি তাতে কি জ্ঞানের বালাই আছে? আমাদের দেশের কয়টি পরিবার সুষম আহার করে বা পুষ্টির কথা মাথায় রেখে রান্না করে? আমাদের দেশের শতকরা কজন মানুষ ক্যালরি বা খাদ্যশক্তি হিসেব করে খাদ্য প্রস্তুত করে? কতোজন মানুষ প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করে? কতোজন মানুষ জানে, পরিশোধিত শর্করা গ্রহণ শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর? কতোজন মানুষ সবজি কাটার আগেই তা ধুয়ে নেয়? কতোজন মানুষ রান্নায় ভাতের মাড় সংরক্ষণ করে? কতোজন মানুষ জানে, শস্যের সবচেয়ে পুষ্টিকর অংশ ধানের কুড়া বা গমের ভুষি? কতোজন মানুষ জানে ও মানে যে সবজি ও ফলের বাইরের অংশ অর্থাৎ ছোলায় পুষ্টি উপাদান সঞ্চিত থাকে? আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ ফল, সবজি ও শস্যের সবচেয়ে পুষ্টিকর ও প্রয়োজনীয় অংশ ফেলে দিয়ে অপ্রয়োজনীয় অংশটুকুই খায়। বছরের পর বছর পড়াশোনা করে আমরা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে যে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি তাতে রয়েছে সাদা, সিদ্ধ চালেরই প্রাধান্য। 

এই চাল প্রস্তুতের যে প্রক্রিয়া তাতে চালের পুষ্টিমান বা খাদ্যমান প্রায় শুন্যে নেমে যায়। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স কিংবা খনিজ লবণের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিউপাদান উধাও হয়ে যায়। অবুঝ শিশুর মতো কেবল স্বাদের কথা বিবেচনা করেই আমরা এই খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলেছি। কিন্তু আমাদের যদি খাদ্য, রান্না ও পুষ্টি বিষয়ে জ্ঞান ও মৌলিক দক্ষতা থাকতো তাহলে আমরা স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পারতাম। আর আমরা জাতি হিসেবে রুগ্নতা থেকে মুক্তি পেতে পারতাম। এজন্য রান্না বিষয়ক জ্ঞানভিত্তিক মৌলিক দক্ষতা অপরিহার্য। রাষ্ট্র শিক্ষাক্রমে এ মৌলিক দক্ষতা যুক্ত করে একেবারে যথার্থ যৌক্তিক, যুগোপযোগী ও সাহসী কাজ করেছে। রাষ্ট্রকে অসংখ্য ধন্যবাদ। রাষ্ট্রের কাছে আর্জি, শিক্ষাহীন আম জনতার মূর্খ আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্র যেনো পিছু না হটে।

ষষ্ঠ শ্রেণির ‘জীবন ও জীবিকা’ পুস্তকে মোট আটটি অধ্যায়ের শেষের দুয়ে দুটো ‘স্কিল কোর্স’ অর্থাৎ দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে।। এর একটি কুকিং বা রান্না বিষয়ক অধ্যায়। এবং তাতে ‘ভাত রান্না’, ‘ডিম ভাজা’ ও ‘আলুভর্তা’ উপঅধ্যায় যোগ করা হয়েছে। ‘ভাত রান্না’ অংশে শিশুদেরকে একটি আদর্শ পরিবারের রান্না ও গৃহস্থালির কাজ-কর্মের গল্প শোনানো হয়েছে। তাতে লেখা আছে, ‘অফিসে যাওয়ার আগে বাবা (রাইয়ানের) বিছানাপত্র গোছান, ঘর-দোর পরিষ্কার করেন। অফিস থেকে ফেরেন সন্ধ্যায়। বাড়িতে ফিরে এসেই আবার রান্নাঘরের কাজ শুরু করেন। বাবা-মায়ের কষ্ট দেখে রাইয়ানও খুব কষ্ট পায়। তাদের কষ্টটা সে একটু কমাতে চায়।’ আমাদের দেশের ক’জন সন্তান পিতা-মাতার কাজে নিয়মিত সহায়তা করে? কজন পুরুষ অফিসে যাওয়ার পাশাপাশি ঘরের বিছানাপত্র গোছান, ঘর-দোর পরিষ্কার করেন কিংবা থালা-বাসন মাজেন বা রান্নাও করেন? সুখী পরিবার কিংবা সুন্দর সমাজ নির্মাণে নারী পুরুষ সবারই সমানভাবে সবকাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়া দরকার-অবচেতনে এমন ধারণাই দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে আলোচ্য অধ্যায়ে।

আবহমান কাল থেকে শিক্ষাকে আমাদের দেশে পুস্তকেই সীমাবদ্ধ রাখার প্রায় সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে। ফলে লোকে শিক্ষাকে পুস্তকের বাইরে বাস্তব জীবনে দেখতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। নতুন শিক্ষাক্রমে ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক’ শিক্ষাক্রম চালু করে দেশে প্রথম বারের মতো শিক্ষাকে পুস্তকের বাইরে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। এই চেষ্টা আমজনতার চোখে অসহনীয় হবে, এটি খুবই স্বাভাবিক। ফলে তারা খুব প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এখন।

সাধারণ লোকে কথার ভাবার্থ বোঝেন না; আক্ষরিক অর্থ বোঝেন। কথার ভাবার্থ বুঝতে বোদ্ধা হতে হয়, সাহিত্যজ্ঞান থাকতে হয়, মননশীল হতে হয়, উন্নত চিন্তার হতে হয়। শুধু সন্তানের অভিভাবক হওয়ার বদৌলতে তা বুঝতে পারার কথা নয়। পাঠ্যপুস্তকে রান্নার প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্তির খবরে অভিভাবকেরা চটেছেন। তারা বিষয়টিকে আক্ষরিকভাবে দেখছেন। খুবই অশ্লীল প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। কেউ কেউ বলেছেন, আমাদের সন্তানেরা কয়েক বছর পর বাবুর্চি হবে। কেউ কেউ আবেগে প্রকাশ্যে কেঁদে দিয়েছেন। এ নিছক অশ্লীলতা বই কিছু নয়। শিক্ষাক্রমে রান্নার প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্তির অর্থ হচ্ছে শিক্ষাকে জীবনমুখী করা, শিক্ষার্থীর পরনির্ভরশীল হয়ে বেড়ে না ওঠা, কাজকে সম্মান জানানো, অবচেতনে নিজের কাজ নিজে করার মানসিকতা তৈরি, রান্নাকে নারীর কাজ বা মেয়েলি কাজ মনে করার প্রচলিত সামাজিক প্রথা ভাঙা এবং সর্বোপরি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সঙ্গে মৌলিক জীবন দক্ষতা অর্জন।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, কালবিলা, হারতা, উজিরপুর, বরিশাল

 

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030221939086914