শিক্ষার্থী যখন একটি বিষয় না বুঝে আধুনিক শিক্ষায় তাকে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা হয়। এক সময় এটি ছিলো এক ধরনের বেয়াদবির পর্যায়ে। শিক্ষককে প্রশ্ন করা মানে শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি করা। নতুন কারিকুলাম বিশাল অঙ্কের শিক্ষকই ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না, বুঝে উঠতে পারছেন না মূল্যায়ন ব্যবস্থা। তারা বিভিন্নভাবে সেটি প্রকাশের চেষ্টা করেন, বিভিন্ন মাধ্যমে প্রশ্ন করেন। একইসাথে অভিভাবকরাও বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এখন প্রশ্ন করা কিংবা কিছু জিজ্ঞেস করা কি অপরাধ?
কর্তৃপক্ষ বার বার বলছে, পরীক্ষা নাই বলে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। তারা বলছেন সামষ্টিক মূল্যায়নই পরীক্ষা। এখন সে বিষয়টি কি সেটি তো শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের বুঝাতে হবে। তারা বুঝতে পারছেনা না বলেই তো এত কথা। কারুর উস্কানি দেওয়ার তো দরকার নেই। কারণ অভিভাবকরা দেখছেন, তাদের ছেলেমেয়েরা এ বছর (২০২৩) লিখিত কোনো পরীক্ষা দেয়নি।
একজন ভালো ছবি আঁকেন সেটির মূল্যায়ন করতে হবে, একজন ভালো নাচতে পারেন সেটিরও একটি স্বীকৃতি থাকতে হবে। একজন ভালো ক্রিকেট খেলেন তার প্রতিফলন থাকতে হবে তার সার্টিফিকেটে। পূর্ববর্তী কারিকুলামে এটির রিফ্লেকশন হতো না, তাই এমন একটি কারিকুলাম দরকার ছিলো যে, এগুলোর মূল্যায়ন হবে, এগুলোর স্বীকৃতি থাকবে। একজন গণিতে ভালো নম্বর পেয়েছেন কিন্তু ভালো বাংলায় কথা বলতে পারেন না, সেটি যাতে কারিকুলামে গুরুত্ব দেওয়া হয় তাই অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু এটিও সত্য সবাই গান করবেন না, সবাই নাচ করবেন না, সবাই ছবি আঁকবেন না। সবাইকে একই কাজ করাতে চাওয়া তো যৌক্তিক নয়।
এই কারিকুলাম কি চাচেছ? সবাই আঁকবেন, সবাই গান গাইবেন? সবাই ক্রিকেট খেলোয়াড় হবেন? এসব কার্যাবলীর একটি স্বীকৃতি, একটি মূল্যায়ন থাকবে মূল বিষয়গুলোর সাথে। মূল বিষয় বাদ দিয়ে শুধু সবাই খেলবেন, সবাই গান গাইবেন বিষয়টি কি তাই? সে রকম প্রশ্নই অনেক অভিভাবকের, অনেক শিক্ষকের। আর ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্রচার ও গণমাধ্যমে অভিভাবকদের মতামত দেখে শিক্ষার্থীরা খেই হারিয়ে ফেলছেন।
যে কোনো মূল্যায়ন ব্যবস্থায় একটি অংশ লিখে প্রকাশ করা থাকতেই হবে। কোনো চাকরির পরীক্ষায় আমরা কি শুধু মৌখিক পরীক্ষাই নিই? কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটি করা হতে পারে। তারপর তার আচরণ, সাহস, দক্ষতা দেখার জন্য মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয় লিখিত পরীক্ষার পর। এটিই বাস্তব। আমাদের শিক্ষার্থীরা কি কেউ লেখক হবেন না? তারা ফরম্যালি কোনো লিখিত কোনো পরীক্ষা দিচ্ছেন না। তাদের কল্পনার জগত কি বিস্তৃত করতে হবে না? কোনো বিষয় নিয়ে না লিখলে সেটি কিভাবে হবে? শুধু দলগত কাজ আর দক্ষতা অর্জনের জন্য বাস্তব কাজ করবেন? শ্রেণিকক্ষে কিছু কিছু শিক্ষক কিছু লিখিয়ে থাকেন সেটি সবাই সমানভাবে পারেন না, করেন না, করার কথাও নয়। এ ধরনের কাজ একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডে মূল্যায়ন করা হয় না বা যায় না। এটি এক শিক্ষক থেকে আরেক শিক্ষক, এক বিদ্যালয় থেকে আরেক বিদ্যালয়, গ্রাম থেকে শহর সব ধরনের বিদ্যালয়ে এটির মূল্যায়ন আলাদা ধরনের হয়।
আমার মনে আছে, যখন রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে ছিলাম সেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পাস করাটাই ছিলো বিশাল এক ভয়ের ব্যাপার। তাদের খাতা শিক্ষকরা এমনভাবে দেখতেন যাতে কলেজে যিনি ৪০ পাবেন, বোর্ডে যেনো সহজেই ৬০ পেয়ে যান। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রথমদিকে যেসব শিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকতেন রাজউকের আন্ত: পরীক্ষায় কোনরকম পাস করা শিক্ষার্থীও বোর্ড পরীক্ষায় তাদের থেকে এগিয়ে থাকতেন। ঢাকার বাইরে সাধারণ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কি অবস্থা?
জাতীয় পর্যায়ে একটি সমান মানদণ্ড অনুযায়ী মূল্যায়নের ব্যবস্থা না থাকলে সবাইকে সমানভাবে নিরীক্ষা করা যায় না। লিখিত পরীক্ষা সেটি নিশ্চিত করে। আর লিখিত পরীক্ষা মানেই মুখস্থ নয়। লিখিত পরীক্ষায় কিছু তথ্য থাকে যেগুলো আত্মস্থ করার বিষয় থাকে, সেটিকে অস্বীকার করা যাবে না। সেটি সব ধরনের মূল্যায়নেই থাকে। লিখিত পরীক্ষায় অনেক সৃজনশীল বিষয় থাকে যা শিক্ষার্থীর লেখার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্রশ্নটি সেভাবে করতে জানা, জানানো এবং শেখানো প্রয়োজন শিক্ষকদের।
আমরা যদি বলি, শিক্ষার্থীরা যাতে শুধুই মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী না হয়ে ওঠেন, তাই লিখিত পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, লিখিত পরীক্ষা মানেই তো মুখস্থ পরীক্ষা নয়। কিছু শিক্ষার্থী কিংবা অনেক শিক্ষার্থী হয়তো তাই করেন বা করতেন। কিন্তু প্রশ্নটা সেভাবে সৃজনশীল করা প্রয়োজন। যেমন আন্তর্জাতিকমানের ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার প্রশ্ন সৃজনশীল। যে প্রশ্ন একবার পরীক্ষায় এসেছে সেই প্রশ্ন দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় আসে না। ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের সব পরীক্ষাই তো লিখিত। আমরা কি এটি অস্বীকার করতে পারবো? সেখানকার প্রাপ্ত গ্রেডিং আন্তর্জাতিক যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো ধরনের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করে থাকে। সেখানে আমাদের মূল্যায়নের পদ্ধতি তারা কিভাবে গ্রহণ করবে সে প্রশ্নও তুলছেন অভিভাবকরা।
যে লেখাপড়া করে শেখামাত্রই দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা যায় সেটা হচ্ছে স্কিল, জ্ঞান নয়। গণিতের তো সরাসরি প্রয়োগ নেই, তাহলে কি গণিত বাদ দিতে হবে? উচ্চতর গণিত কি সেজ্যই বাদ দেওয়া হয়েছে? গণিত, উচ্চতর গণিত মেধা বিকাশের চর্চায় যে অবদান রাখে তার কোনো গবেষণা আমাদের দেখা যায় না। তবে সাধারণ দৃষ্টিতেও কিন্তু বুঝা যায়- যার গাণিতিক জ্ঞান বেশি তাকে যেখানেই দেওয়া হয় সেখানেই সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। একটি দেশের মেইন স্ট্রিম শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সুদূরপ্রসারী লাভ। ভবিষ্যতে বড় লাভের প্রস্তুতি হতে হয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের শিক্ষায়। আর স্বল্প মেয়াদি লাভের বা যে লেখাপড়া শিখেই কাজে লাগানো যায় সেটাকে বলে কারিগরি শিক্ষা বা ভোকেশনাল শিক্ষা। এজন্যই একটি দেশের শিক্ষার স্তরকে কয়েকটিভাগে ভাগ করা হয়। যেমন জার্মানির মেইন স্ট্রিম শিক্ষাকে বলে জিমনাসিয়াম, কারণ এই শিক্ষাটা ব্রেইন স্টর্মিং। এই শিক্ষা সুদূরপ্রসারী। যে শিক্ষায় আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্ল্যাং, গোদেল, হাইসেনবার্গ তৈরি হয়েছেন।
সমাজের একটি শ্রেণির জন্য কারিগরি শিক্ষার একটি ধারা অবশ্যই থাকতে হবে। তাদের জন্য উচ্চ শিক্ষার দ্বারও উন্মুক্ত রাখতে হবে। যার যখন ইচ্ছে তখন যেনো তার কাঙ্খিত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পারেন। সেটিও আমাদের দেশে রুদ্ধদ্বারের মতো। এটি নিয়ে কাজ করা দরকার। এটিও সত্য যে, সবাই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করবেন না, সবাই উচ্চশিক্ষাও গ্রহণ করবেন না। তবে, সবার জন্যই সব দ্বার উন্মুক্ত রাখতে হবে, বাধ্যবাধকতা দিয়ে নয়।
নতুন কারিকুলামে ‘জীবন ও জীবিকা’, তথ্য প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয় ঢুকিয়ে একই সাথে এদের জন্য স্থান তৈরি করতে ফান্ডামেন্টাল বিষয় যেমন পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, রসায়নকে তরলীকৃত করা হয়েছে। আর উচ্চতর গণিতকে বলতে গেলে একদম নাই করে দেওয়া হয়েছে। একইসাথে আগের বিভাগ উঠিয়ে দিয়ে সবাইকে সব বিষয় পড়তে বাধ্য করা হয়েছে। আগে যিনি বিজ্ঞান বিভাগ নিতেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে গিয়ে বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে যে কোনো বিষয় পড়তে পারতেন। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশুনা করেছি। আমাদের ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী ছাড়া সবাই ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞানপড়া, অর্থাৎ সবাই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসেছিলেন। আমাদের ব্যাচের ইতিহাস বিভাগে সবাই এসেছিলেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বাংলায় যারা পড়েছেন তাদের মধ্যেও অনেকেই ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আসা। এখন নতুন শিক্ষাক্রমে যা করা হলো তা হচ্ছে যারা উচচতর গণিত, বিজ্ঞান ভয় পেতেন তারা যেনো ভয় না পান নবম-দশম শ্রেণির বিষয় ও সূচি এমনভাবে সাজানো হয়েছে। অর্থাৎ আগের বিজ্ঞানের কঠিন মানকে নিচে নামিয়ে এবং মানবিক ও ব্যবসার মানকে ওপরে উঠিয়ে একটা গড় মানে নামানো হয়েছে। সবার জন্য করতে হলে নামাতেই হবে। তাহলে আগের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে যতোটুকু জানতেন, তার চেয়ে কম জেনে বিজ্ঞান বিষয় পড়তে এলে অনেক সমস্যা হবে, হাফডান হবে। বিষয়টি আমরা হয়তো চিন্তা করে দেখিনি।
সবশেষে বলতে চাচ্ছি, আমাদের কর্তৃপক্ষ দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলাম চালু করেছেন। চালু করার পর পজেটিভ-নেগেটিভ অনেক কিছুই সামনে আসছে। চালু না করার আগে শুধু কাগজপত্রে এর বিভিন্ন দিক উঠে আসে না। এখন আসছে বলেই একজন শিক্ষক হিসেবে সেগুলো নিয়ে মতামত জানিয়ে আসছি, লিখছি। কর্তৃপক্ষ কি করবেন সেটি তাদের বিষয়। তবে, শিক্ষাদান আনন্দের মাধ্যমেই করাতে হয়। সেই আনন্দ কিভাবে হবে সেটি একটি বিশাল চিন্তার বিষয়। কোমলমতি শিক্ষার্থী থেকে অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত এক ধরনের নির্দিষ্ট মাত্রায় শিক্ষার্থীদের এক ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে রাখতে হয়। তাদেরকে যদি সব কিছু থেকে মুক্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাতে তারা বেজায় খুশী। তাতে তারা যে কিছু অর্জন করবেন না তা নয়। কিন্তু শিক্ষালয় হচ্ছে সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এগুলো কিছু নিয়ম ও কিছু বাধ্যবাধকতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পুরোপুরি দায়িত্ব নেওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের হয় না, সেটি উচচশিক্ষায় হয়। সেখানেও কিন্তু বাধ্যবাধকতা আছে। শিক্ষার্থীরা একটু বাধ্যবাধকতার মধ্যে না থাকলে তারা কেনো শিখবেন, কেনো শিখতে বিদ্যালয়ে আসবেন সেই বোধ বা বুঝ কিন্তু তাদের হয়নি। এই বিষয়টি আমরা ভেবে দেখবো কী?
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।