মানুষের জীবনের স্বাভাবিক আচার আচরণের মূল শিক্ষাটি দিয়ে থাকেন একজন শিক্ষক। শিক্ষক হলেন গুরুজন, গুণীজন, মানুষ গড়ার কারিগর এবং একটি জাতির বিবেক। শিক্ষক হচ্ছেন সমাজের আলোক শিখা, জ্ঞানের ভান্ডার। যাদের ভালোবাসা, স্নেহ ও শাসনে শিক্ষার্থীরা বিদ্যাপীঠে বেড়ে ওঠেন। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে আলোকময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যান। শিক্ষকের আদর্শে নিজেকে আদর্শিক মানুষ হিসেবে তৈরি করে নেতৃত্ব দেয় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ছাপিয়ে বিশ্বময়।
শিক্ষকতা একটি অনন্য উচ্চতার মহান দায়িত্ব। শিক্ষকতা শুধু একটি চাকরি নয়, শিক্ষকতা হলো একটি ব্রত, একটি আদর্শ, একটি নৈতিক মানদণ্ড। ‘শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকা বহনকারী এবং মানবজাতির অগ্রযাত্রার রূপকার। মহান পেশা শিক্ষকতায় উপরোক্ত শব্দগুলো খুবই হাস্যকর ও অসম্মানজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে অভিশপ্ত বেসরকারি নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের কাছে। সময়ের চাহিদা ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু নন-এমপিও শব্দযুক্ত শিক্ষকদের জীবন স্থবির হয়ে গেছে। থমকে গেছে স্বপ্ন বুননের কারুকাজের ছন্দময় কথামালা। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে ‘এ দেশ স্বাধীন তো’! লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। অথচ এখনো স্বাধীন দেশের কতিপয় শিক্ষক পরাধীনদের মতো ন্যায্য পাওনা আদায় করতে ত্রিশ বছর যাবৎ বঞ্চনা সহ্য করে আজও কোনোরকমে টিকে আছেন সুদিনের আশায়।
কেমন আজব এক এমপিও নীতিমালাহীনতায় আটকে আছে এমপিওভুক্তি। দু’মুঠো ভাতের জন্য তাদের রাস্তায় নামতে হয়, ভাবতেও কষ্ট হয়। জাতি গড়ার কারিগরদের যদি দু’মুঠো ভাতের অধিকারের জন্য দিনের পর দিন রাস্তায় ঘুরতে হয় তাহলে শিক্ষিত জাতি গঠনের স্বপ্নপূরণ হবে কীভাবে? শিক্ষাব্যবস্থার কেনো এমন দুরবস্থা? শিক্ষকদের কেনো বেতনের জন্য কাঁদতে হবে? শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যারা আছেন তারা কি দেখেন না? নাকি অন্ধ-বধির সেজে বসে থাকেন?
মহান জাতীয় সংসদে কতো চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলে কিন্তু বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে বেধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত অভুক্ত শিক্ষকদের আহাজারি কিংবা এমপিওভুক্তির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নিকট উপস্থাপন করার মতো কেউ একজন কি নেই? ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, মানবতার মা, বিশ্বের বিস্ময়, বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশে শিক্ষায় এই বৈষম্যে থাকা কতোটা যুক্তিসম্মত?
নিত্যপণ্যের মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি শিক্ষক নামধারী কতিপয় মানুষের হাহাকার দেখার কেউ নেই। ‘পকেটে টাকা নেই’ এই শব্দটি যখন প্রতিনিয়ত ব্যবহারের হয়ে যায়, তখন বিনা কারণে চোখের কোণে জল জমা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। বাচ্চার কয়েকটি আবদার পূরণ করা, বাবা-মায়ের ওষুধ কেনা, নিজের সামান্য প্রয়োজনেও ‘টাকা নেই’ শব্দটি কতোবার আর উচ্চারণ করা যায়? অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের অপরাধ কী? তারা কি এদেশের নাগরিক নয়? তারা কি রাষ্ট্রে প্রচলিত আইনের অধীনে নয়? এমপিওভুক্ত কলেজের নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে জনবল কাঠামোর বাইরে থাকায় এমপিওভুক্তির আওতায় আসেনি।
এদিকে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী কম থাকা ও কলেজে ভেদে অব্যবস্থাপনার কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ নামমাত্র বেতনটুকুও দিতে না পারায় স্বাভাবিক মানের জীবন-যাপন করতে পারছেন না সারা দেশের নন এমপিও সাড়ে ৫ হাজার বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা। দৈনন্দিন জীবন-জীবিকার চিন্তায় দিশেহারা অবস্থায় পড়েছেন এসব শিক্ষক। ‘শিক্ষক’ হয়ে লজ্জায় না পারছেন কারো কাছে হাত পাততে, না পারছেন চাকরির মোহ থেকে বেরিয়ে এসে অন্য কোনো কাজ করতে।
প্রতিবছর ঈদ, পূজার মতো ধর্মীয় নানা উৎসব আসে মহাসমারোহ, আবার চলেও যায়। সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা বেতন-উৎসব ভাতা পেলেও, অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও না থাকায় বোবা কান্না আর গগণবিদারী আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়’। প্রিয় সন্তানের লাল জামা কেনার স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যায়। যেখানে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ অনেক মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে, এগিয়ে চলে দেশ। সেখানে দেশের উচ্চশিক্ষা স্তরে বিধিমোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা কঠিন অর্থ সংকটে পড়েছেন। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী গেলো, মুজিব শতবর্ষ গেলো কিন্তু জাতি গড়ার কারিগররা রুটি-রুজির চিন্তা থেকে বের হতে পারেননি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতির সমন্বয়হীনতায় অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের ভাগ্যে এমপিও নামক ‘সোনার হরিণ’ অধরাই রয়ে গেছে। অথচ মাসিক ১২ কোটি হিসেবে বার্ষিক ১৪৪ কোটি টাকা বাজেট ব্যয় বরাদ্দ হলেই অবহেলিত শিক্ষকদের স্বপ্ন পূরণ হতো, বেঁচে থাকার সুযোগ হতো। অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধিমোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও শুধুমাত্র জনবল কাঠামোর অজুহাত দিয়ে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে নন-এমপিও! ফলে প্রতিষ্ঠান এমপিও হলেও, এসব শিক্ষকেরা সরকারের কোনো সুযোগ-সুবিধাই পায় না। প্রতিষ্ঠান ভেদে পাঁচ/দশ হাজার টাকা দেয়া হয় যা অত্যন্ত অমানবিক। সুধী সমাজ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষককে জনবল কাঠামোয় অর্ন্তভুক্ত করে এমপিও এর কথা জোড়ালোভাবে উত্থাপন করলেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তা বারবার উপেক্ষিত। একটা প্রশ্ন বারবার মনে আসে-‘জনবল কাঠামোর জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য জনবল কাঠামো?’
দেশে বেসরকারি কলেজে অনার্স-মার্স্টাসের শিক্ষকেরা বিনা বেতনে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চশিক্ষায় পাঠদান করে যাচ্ছেন। সামান্য কিছু টাকা নাকি সরকারের কাছে বোঝা। অথচ এই দেশে ভিনদেশি রোহিঙ্গাদের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। একই ধরনের নিয়োগ নিয়ে কলেজ সরকারি হওয়ায় আত্তীকরণের মাধ্যমে ক্যাডার হয়ে আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন অনেক কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক। আর বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকের এমপিও’র জন্য কতো আলোচনা, দফায় দফায় কতো বৈঠক, ভিক্ষুকের বেশে শূন্য থালা হাতে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি, কতো স্মারকলিপি, কতো আশ্বাস, কতো লোকের পিছু হাঁটা সবই বৃথা, মরীচিকার পিছু দৌড়ানোর মতো। বাংলাদেশ এক অদ্ভুত বুদ্ধিজীবীদের দখলে।
উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যেনো মুখে তালা লাগিয়ে বসে আছেন। কেউ বলেন না- কেনো এদের এমপিও হয় না? একজন শিক্ষকের কাছে লোকে যখন জানতে চায় ‘বিল হইছে গো?’ তখন মুচকি হাসি দিয়ে হয়তো মিথ্যে বলতে না হয় এড়িয়ে যেতে হয়। এভাবে আর কততো দিন? চরম হতাশায় ডুবে আছে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা। সৃষ্টিকর্তা কি এদের মতো অসহায়দের পাশে দাঁড়াবেন না? সারা জীবন চাকরি নামক বস্তুটি গায়ে সিল মোহরের মতো লাগিয়ে-না খেয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে আরো নিকৃষ্ট অপমানের পথে হেঁটে যাবে অনন্তকাল।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ উক্তি-বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের মনে উঁকি মারে বারবার-‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’।
লেখক: নন-এমপিও অনার্স শিক্ষক, সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজ
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]