বিংশ শতকে বাংলার মহিলা জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ লীলা নাগ প্রতিষ্ঠা করেন দীপালি সংঘ। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত দীপালি সংঘ শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত সমাজ কোনোদিনই নারীকে গৃহের গণ্ডি থেকে মুক্তি দিতে চায়নি বরং মাতৃত্বের ভাবমূর্তির মধ্যেই বেঁধে রাখতে চেয়েছে। নারীবাদীরা সামাজিক বিধিনিষেধ বা অর্থনৈতিক পরাধীনতার বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে সচেষ্ট হয়নি। কিন্তু কিছু ব্যাতিক্রমী নারী ছিলেন যারা এই ছকে বাঁধা গণ্ডি অতিক্রম করে স্ব-ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। সমাজ সংস্কার, জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন এই সকল বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক বিন্যাসের বাইরে তারা লিপ্ত হন।
আত্মসচেতনা নারীকে সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারবিরোধী বলে মনে করা হয়। বৃহত্তর সমাজ চেতনার বাইরে এক বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে সে হয়ে ওঠে ব্যাতিক্রমী-এই ব্যাতিক্রমীদের মধ্যেও ব্যাতিক্রমী ছিলেন লীলা রায় ও তার ‘দীপালি সংঘ’। ঔপনিবেশিক যুগ এবং উত্তর ঔপনিবেশিক যুগের আপাত ভিন্নতর পরিস্থিতিতে কীভাবে তিনি নারী কল্যাণ কর্মসূচি রূপায়িত করেছিলেন তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
গান্ধীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীদের জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে বড় রকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশ শতকের গোড়াতে একাধিক নারী-সংগঠন গড়ে ওঠেছিলো গেইল পিয়ারসনের ভাষায় ছিলো ‘প্রসারিত মহিলাক্ষেত্র’ যা ছিলো পৃথক গৃহস্থ পরিবার ও ব্যাপকতর জনজীবনের মাঝখানে অবস্থিত। জেরাল্ডিন ফোর্বস তার ‘Women in Modern India’ (১৯৯৮) গ্রন্থে দেখিয়েছেন ‘মহিলা-সংগঠনগুলির উদ্যোগ এবং কর্মীদের কাজকর্ম সব সময়ে সামাজিক নারীবাদী ভাবাদর্শের কাঠামো’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত’, এই কথাটি হয়তো ‘দীপালি সংঘ’র জন্যে প্রযোজ্য হয়নি।
বাংলার নারী সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন অভিশপ্ত জীবনে শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞানের আলো বিকিরণের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দীপালি সংঘ’। মূলত আদর্শ জননী রূপে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নয়, উদ্দেশ্য ছিলো পূর্ণ মনুষ্যত্বের অধিকারী করে তোলা। দীপালি সংঘের কার্যকলাপ ঢাকা শহরের সর্বত্র নবজাগরণের সূচনা করেছিলো। সে যুগে মেয়েদের সংগঠিত করে কর্মে নিয়োগ করা ছিলো এক অসাধ্য কাজ। লীলা নাগ সেই অসাধ্য সাধনে ব্রতী হলেন। ‘দীপালি সংঘ’ মেয়েদের মধ্যে দীপের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত ঢাকায় দীপালি সংঘের রেজিস্টার থেকে কয়েকজন সদস্যের নামের তালিকাও জানা যায়- আরসি রায়, অমলা বসু, এম চৌধুরী, ফুলা গুপ্ত, লীলা নাগ, বীণা দত্ত, লতিকা রায়, লীলা রায়, এস. দাশগুপ্ত, মনোরমা বসু এবং কমলা বসু। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে দীপালি সংঘের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে আয়োজিত সভা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। রবীন্দ্রনাথকে তারাই প্রথম অভিনন্দন জানান। এই মহতী সভা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সমগ্র এশিয়ায় এ রকম সুশৃঙ্খল মহিলা সভা আর দেখিনি’। মহাত্মা গান্ধীও দীপালি সংঘের কার্যাবলি দর্শনে বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করেন।
দীপালি সংঘ স্থাপনের সময় লীলা নাগ অনুভব করেন ঢাকার উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী মেয়েদের জন্য একটি মাত্র উচ্চ বিদ্যালয়, ইডেন স্কুল যথেষ্ট নয়। সেই জন্য তিনি বিনা বেতনে কাজ করে আর একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রথমে এর নাম ছিলো ‘দীপালি হাইস্কুল’। তিনি সেখানে তিন বৎসর বিনা বেতনে কাজ করে এর স্থায়িত্ব বিধান করেন। এখন এটি কামরুন্নেসা হাইস্কুল নামে পরিচিত (১৯২৩)। গোড়ার দিকে প্রধানত উচ্চবর্ণীয় হিন্দু মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের মধ্যে কাজ শুরু হলেও অচিরেই লীলা নাগ মুসলিম মহিলাদের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন এবং সেইজন্য তিনি দীপালি স্কুলের নাম করেন কামরুন্নেসা স্কুল। খাজা আহসানউল্লাহ ছিলেন ঢাকার নবাব; তার চার স্ত্রী ছিলে, তাদের মধ্যে একজনের নাম কামরুন্নেসা।
তার নামানুসারেই কামরেন্নসা স্কুল হয় (বর্তমানে কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা)। এরপর দেখা যায় যে মধ্যবিত্ত, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মুসলিম মেয়েরা দলে দলে স্কুলে আসতে থাকে যা এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ২রা ফেব্রুয়ারি তিনি স্থাপন করেন নারী শিক্ষা মন্দির-যা পরবর্তীকালে হয়েছে ‘শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় ওয়ারী, ঢাকা। এই কার্যে অর্থ সাহায্য দানে ‘দীপালি সংঘ’ বিশেষ সহায়তা করেছে। এভাবে ঢাকা শহরে আরও কয়েকটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন লীলা নাগ। ঢাকার স্কুল গুলি হলো-নিউ হাইস্কুল (অভয় দাস লেন), শিক্ষা ভবন (বকশী বাজার), শিক্ষায়তন হাইস্কুল (কায়েতটুলী), শিক্ষালয় (হেয়ার স্ট্রিট), বাংলা বাজার বালিকা বিদ্যালয় (বাহাদুর শাহ পার্ক সংলগ্ন)। নারী শিক্ষা ব্যাপকতর করার জন্য লীলা নাগ ঢাকা শহরে ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। কাজেই বিশের দশকে ঢাকা শহরের আয়তনের তুলনায় বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম ছিলো না। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে জেলায় তার স্বগ্রাম পাঁচগাঁয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তা এখনো তার মায়ের নামানুসারে কুঞ্জলতা নাগ বেসরকারি বিদ্যালয় হিসেবে টিকে আছে।নারী জাগরণের মূল আঁধার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত ছাড়া ঢাকায় দীপালি সংঘের কার্যকলাপের মধ্যে ছিলো, বয়স্কশিক্ষা কেন্দ্র, কুটিরশিল্প শিক্ষাকেন্দ্র, মহিলা পাঠাগার, ব্যায়ামাগার, খেলাধুলা, কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল, দীপালি ভাণ্ডার, নারী রক্ষা ফান্ড, সংগীত অভিনয় ও চিত্তবিনোদন। এ ছাড়াও নানা সেবামূলক কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিলো। প্রত্যেকটি বিষয়ে আলাদা ব্যবস্থা ছিলো। লীলা নাগ ‘দীপালি সংঘের’ শিক্ষিত মেয়েদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন। সংঘের মহিলাদের আরও কাজ ছিলো বৃক্ষরোপণ, সবজি চাষ, তুলা উৎপাদন এবং প্রতিদিন কোনো না কোনো কল্যাণমুখী কাজ সম্পন্ন করা-যেমন বয়স্ক মহিলাদের সাক্ষরতায় উদ্বুদ্ধকরণ, মেয়েদের স্কুলে পাঠানো, বাল্যবিবাহ রোধ, অস্পৃশ্যতা দূর ইত্যাদি। পারস্পরিক বন্ধনে নিবিড় ঐক্যের লক্ষ্যে সাপ্তাহিক ও মাসিক সভায় উপস্থিতি ছিলো আবশ্যক।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে দীপালি সংঘ গড়ে ওঠার পর ঢাকা, কলকাতা ও অন্যান্য জায়গায় সর্বত্র তাদের প্রভাব বিস্তার করার পাশাপাশি ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক পর্ব। দীপালি সংঘ নারী সংঘ থেকে বিপ্লবী গোষ্ঠী শ্রীসংঘের বৈপ্লবিক সংঘে রূপান্তরিত হয়। এই সময় থেকে শ্রীসংঘের মহিলা বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে দীপালি সংঘ কাজ করতে থাকে। প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দারের হাতে খড়ি হয়েছিলো এই দীপালি সংঘে। ১৯২৩-১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের0 মধ্যে দীপালি সংঘের আদর্শ ও লক্ষ্য-নারীর বন্ধন-মুক্তির সংগ্রাম থেকে মাতৃভূমির বন্ধন-মুক্তির বৈপ্লবিক সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী-সংগঠনের যে বীজ লীলা রায় বহন করেছিলেন তা পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘জাতীয় মহিলা সংহতি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়ে মেয়েদের মধ্যে সমাজসেবা, শিক্ষামূলক কাজের বিস্তার, নারী সমাজে বঞ্চনার প্রতিবাদ ও নারী সত্তার সামগ্রিক বিকাশের জন্য কলিকাতায় মহিলা সহকর্মীদের নিয়ে তিনি ‘জাতীয় মহিলা সংহতি’ গঠন করেন। দীপালি সংঘের আদর্শ ও কর্মপন্থার ধারাবাহিকতা বর্তমানেও চলেছে জাতীয় মহিলা সংহতি।
১৯২০’র দশক থেকে ১৯৬০ দশক পর্যন্ত প্রায় চার দশকব্যাপী বিস্তৃত লীলা রায়ের কর্মজীবন। পাশ্চাত্যে নারীবাদী চিন্তার বিকাশ ও বিস্তারের বিভিন্ন পর্যায়ে Virgina Woolf -এর ‘A Room of One’s own (১৯২৯) থেকে শুরু করে Simone De Beauvoir এর ‘The Second Sex (১৯৪৯), Betty Frieden-এর ‘The Faminine Mystique’ (১৯৬৩) প্রমুখ নারীবাদী চর্চায় পাশ্চাত্যের একচেটিয়া একাধিপত্যের বিরোধিতা করেছিলেন বেগম রোকেয়া। তার যথার্থ উত্তরসূরী হিসেবে লীলা নাগ ‘দীপালি সংঘের’ মাধ্যমে সেই ধারাকে প্রবাহমান করেছিলেন এবং তাদের অনেক আগেই নারীবাদ চর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ‘দীপালি সংঘ’ প্রতিষ্ঠার একশো বছর বাদেও সেই চর্চা অনেকটাই অনালোচিত। তাই বর্তমান জনজীবনে নিরপেক্ষ ইতিহাস চর্চার আলোকে নারী জাগরণ ও নারীবাদী ইতিহাস চর্চায় ঢাকার ‘দীপালি সংঘের’ কার্যাবলির অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সিধু-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।