আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে অষ্টম এবং নবম-দশম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান চালু হওয়ার কথা রয়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষের ছয় মাস হতে চললেও এই তিন শ্রেণীর শিক্ষাক্রম লেখার কাজ শুরুই হয়নি। যদিও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের দাবি, অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষাক্রম রচনার কার্যক্রম প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এখন একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ কারণে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে যথাসময়ে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান চালু করা নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। রোববার (২১ মে) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, আগামী বছরের প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এজন্য আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক এবং অক্টোবরের মধ্যে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক ছাপার পুরো কার্যক্রম শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। এমনিতে বছরের শেষ অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপার পুরো কার্যক্রম শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, জাতীয় নির্বাচনের কারণে বই ছাপার কাজ এগিয়ে আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বেশির ভাগ দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
এনসিটিবি সার্বিক বিবেচনায় ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রাথমিকের সব বই এবং ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মাধ্যমিকের সব বই ছাপা ও সরবরাহ শেষ করতে চান বলে জানান এনসিটিবি চেয়ারম্যান।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনের কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কার্যক্রম দুই মাস আগে শেষ করতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখেই ইতোমধ্যে দরপত্র কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ৮ ও ১৬ মে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা এনসিটিবির ‘বিতরণ নিয়ন্ত্রক’ মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি অষ্টম শ্রেণীর বইয়ের দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রেখেছেন। নতুন শিক্ষাক্রমের ‘সিডি’ বা পান্ডুলিপি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অষ্টম ও নবম-দশম শ্রেণীতে ১৩টি করে বিষয়ের বই পাঠদান হবে। এখন পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণীর কয়েকটি বইয়ের ‘সিডি’ বা ‘কনটেন্ট’ প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু একটি বিষয়ের বইও চূড়ান্ত হয়নি। আর নবম-দশম শ্রেণীর বই লেখার কার্যক্রম এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। সম্ভাব্য সময় অর্থাৎ জুনের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমের বই লেখার কাজ শেষ না হলে পুরনো বই ছাপার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে মোট দশটি বই পড়তে হয়। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের বই মিলিয়ে প্রতিটি শ্রেণীতে মোট বই ১৩টি। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে ১৩টি করে মোট ২৬টি বই রয়েছে। এগুলোর সবকটির সম্প্রতি সংশোধনী প্রকাশ করা হয়েছে।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে। ‘জাতীয় শিক্ষাক্রমের’ আলোকে এই প্রণয়ন করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে ‘তড়িঘড়ি’ করে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের অভিযোগ উঠে। এতে নানা ভুল, অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উঠে আসে। এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। এরপর বইগুলোর সংশোধনী প্রকাশ করা হয়।
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এনসিটিবি এবারও একই ‘ভুল’ করছে বলে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন। ‘সুনির্দিষ্ট’ পরিকল্পনা না থাকা এবং শিক্ষাক্রম প্রণয়নে ‘স্বজনপ্রীতি’র মাধ্যমে লেখক প্যানেল তৈরির কারণে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষাক্রম প্রণয়নেও ‘বিশৃঙ্খলা’ হয়। এতে দুই শ্রেণীর বইগুলোতে পরবর্তীতে অন্তত ৪২১টি সংশোধনী দেয়া হয়।
জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেন, গত বছর ‘গোঁজামিল’ দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম রচনা করা হয়েছে। এবারও ‘গোঁজামিল’ দিয়েই তা করা হচ্ছে।
মূলত পরিকল্পনা ও আন্তরিকতার অভাব, অব্যবস্থাপনা এবং দক্ষ ও যোগ্য লোকদের দায়িত্ব না দেয়ার কারণে ‘গোঁজামিল’ দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের বই রচনা করতে হচ্ছে বলে মনে করেন শেখ ইকরামুল কবির।
এই ‘গোঁজামিলের শিক্ষাক্রমে’ শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে-মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তবে কর্মকর্তারা লাভবানই হবেন। কারণ প্রকল্পের মাধ্যমে এসব করা হচ্ছে। টাকা-পয়সাও ইচ্ছে মতো খরচ হচ্ছে। শিক্ষানীতি আমলেই নেয়া হচ্ছে না।’
অধ্যাপক ইকরামুল কবির শিক্ষানীতির উদাহরণ টেনে বলেন, ‘সেখানে খেলাধুলা ও শরীর চর্চা নামের একটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। আমাদের সুপারিশ ছিল-বিষয়টি নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হবে; পাবলিক পরীক্ষায় বিষয়টি থাকবে না। কিন্তু বিষয়টি চালু করে দুই বছর রাখা হয়; পরবর্তীতে কক্সবাজারে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে কর্মশালার মাধ্যমে বিষয়টি বাদ দেয়া হয়। আমিও সেখানে ছিলাম।’
২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান করার পরিকল্পনা ছিল শিক্ষা প্রশাসনের। নানা ‘অব্যবস্থাপনার’ কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করতে পারেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ কারণে ২০২৪ সালে প্রাথমিকের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে শিক্ষা প্রশাসনের। এর মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিকের তিন শ্রেণীর ‘সিডি’ প্রণয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার দায়িত্বে আছেন এনসিটিবির ‘উৎপাদন নিয়ন্ত্রক’ অধ্যাপক সাইদুর রহমান। তিনি শনিবার (২০ মে) বলেন, প্রাথমিকের বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা এনসিটিবিকে জানানো হয়েছে। তারা সেই অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করেছেন। ‘সিডি’ বা ‘পা-ুলিপি’ চূড়ান্ত হলে সেই অনুযায়ী বই ছাপার ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ বা কার্যাদেশ দেয়া হবে বলে জানান সাইদুর রহমান।
পরবর্তীতে ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণী, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে শিক্ষা প্রশাসনের।
২০১২ সালে সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে ১৯৯৫ ও ১৯৭৬ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়। সরকার ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করলেও এর অনেক কিছুই বাস্তবায়নের বাকি রয়েছে।