ফরিদপুর জেলার সদরপুরে চরাঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, অনিময়, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছারিতার কারণে শিক্ষার্থীরা দূরাবস্থার মধ্যে পতিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, উপজেলার চরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি স্কুলে কোন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়মিত স্কুলে যান না। তারপরেও তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়নি। স্কুলে উপস্থিত না থেকেও নিয়মিত সুযোগ-সুবিধা বন্ধ না হওয়ায় বেশ খোশমেজাজেই চলছেন তারা।
দেয়ারা নারিকেল বাড়িয়া ইউনিয়নের ১২৪নং হকিয়তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রোজিনা আক্তারসহ আরো দু’জন শিক্ষীকা দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে যান না। স্লিলিপ, রুটিন মেইনটেন্স, প্রাক-প্রাথমিক বা অন্য কোন সরকারি বরাদ্দের কাজ না করেই বেতনের টাকা পকেটস্থ করতে কোন সমস্যায় পড়তে হয় না তাদের। এভাবেই চলছে স্কুলটি শুরু থেকেই। যদিও স্কুলে কোন শিক্ষার্থী নেই, শুধুমাত্র খাতায় নাম আছে। তাও কতজন শিক্ষার্থীর নাম সঠিক আছে বলা মুশকিল। এই স্কুলের শিক্ষকরা ২০২২ সালে মোট ২২ দিনও স্কুলে উপস্থিত হয়েছেন কিনা সন্দেহ। এই স্কুলে উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রধান শিক্ষক নিজেও জানেন না। ইতোপূর্বে প্রায় দেড় থেকে পৌনে দু’শ’ শিক্ষার্থী দেখিয়ে সব শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির অর্থ প্রধান শিক্ষকের পকেটে গেছে বলে কথা উঠেছে।
অথচ এই স্কুলে বাস্তবে কোন শিক্ষার্থীই নেই, শুধু খাতায় নাম আছে। ১৩নং পশ্চিমচর নাছিরপুর, ৫৪নং চরখাটারিয়া এবং ৫৫নং কাড়ালকান্দি স্কুলেরও একই অবস্থা। কোন শিক্ষক-শিক্ষিকাই স্কুলে উপস্থিত হন না। স্কুলে সরকারি বরাদ্দের কোনো কাজই এখানে করা হয় না। ৮৫নং বিশ^নাথপুর স. প্রা. বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসের পর মাস উপজেলা শহরে তেলের ব্যবসা করেন। ১২৩নং চরডুবাইল স. প্রা. বিদ্যালয়েও কোন প্রকার সরকারি বরাদ্দের কাজ হয় না। শুধু ভুয়া ভাউচার জমা দিয়েই দায় শেষ। এই স্কুলে ৫ জন শিক্ষিকা কর্মরত। অথচ ক্লাশরুম শিক্ষার্থী-শূন্য। শ্রেণি কক্ষে কেবল বেঞ্চ সাজানো রয়েছে। শিক্ষিকারা বসে খোশগল্প করে সময় পার করছেন। ৬৪নং নারিকেল বাড়িয়া বিষ্ণুপুর, ৬৬নং রেহাই রামনগর, ৬৫নং পূর্ব চর রামনগর, ৫১নং দক্ষিণ চরডুবাইল স্কুলে শিক্ষক উপস্থিতি খুবই কম। দুপুরের দিকে ২-১ জন উপস্থিত হলেও হাজিরা খাতায় নাম তুলেই বিদায় হয়ে যান। ১০৭নং দক্ষিণ চরডুবাইল সরোজা বেগম স্কুলের সহকারি শিক্ষিকা রাবেয়া বেগম দীর্ঘদিন পিটিআইতে প্রশিক্ষণের কথা বলে অনুপস্থিত থাকার কারনে বিভাগীয় মামলা হলেও অদৃশ্য কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন। ১১১নং ইসমাইল মাতুব্বরের কান্দি স্কুলের কোন শিক্ষক সঠিক সময় স্কুলে উপস্থিত থাকেন না। যদিও উপস্থিত হন তাও বেলা ১১টার পরে এবং চলে যান ১টা বাজার আগেই।
এই হলো চরাঞ্চালের শিক্ষা ব্যবস্থা। অনেক অভিভাবক আক্ষেপ করে বলেন, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পড়াতে পারলাম কই? স্কুলে শিক্ষক আসে না। ছেলে-মেয়েরা পড়তে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে মাদ্রাসায় পাঠাই। বাংলা আর পড়াতে পারলাম না। ছেলে-মেয়েদের দ্বীনের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। এছাড়া অন্য কোন উপায়ও নেই। আর এভাবেই শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, অনিহা আর অবহেলার কারনে দিন দিন শিক্ষাথীর্রা স্কুল ছেড়ে হয়তো মাদ্রাসা বা কাজের খোঁজে বেড়িয়ে পড়ছে। যে কারণে শিক্ষার্থী-শূন্য হয়ে পড়ছে বিদ্যালয়গুলো। এসব স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা বিগত ২০১৮-১৯ ও ২০২১-২২ অর্থ বছরে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কমিটির অনুমোদন ক্রমে বিদ্যালয় মেরামত ও সংস্কার, স্লিপ, রুটিন মেইনটেন্স, প্রাক-প্রাথমিক ইত্যাদির কাজ না করেও অনেকেই ভুয়া ভাউচার দিয়ে টাকা উত্তোলন করে নিচেছন। উল্লেখিত টাকা কোন কাজে কোথায় ব্যয় করা হচেছ তা অভিভাবকরা অবগত নন। প্রাথমিকের টাকা ও উন্নয়ন বরাদ্দের টাকা প্রধান শিক্ষকরাই আত্মসাৎ করেন বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষিকা রোজিনা আক্তার ও প্রিয়ন্তি নদীর সাথে কথা হলে রোজিনা আক্তার বলেন, আমার স্কুলে বরাদ্দের সবই করা হয়েছে। আমি যা কিছু করি, সেসব ওপরে জানিয়েই করে থাকি। তারপরও কয়েকদিন স্কুলে অনুপস্থিতির কারণে আমার বেতন কেটে রাাখছে।
রামনগর স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা রনি আক্তার বলেন, স্কুলে বরাদ্দের কোন কাজ করা হয়েছে কিনা আমি কিছুই বলতে পারবো না। তিনি স্কুলের সময় লাইব্রেরিতে ঘুমিয়ে ছিলেন কেন জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, স্কুলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নেই, তাই একা টেবিলে একটু কাৎ হয়ে ছিলাম।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. মালেক মিয়া জানান, আমিতো একা সব স্কুলে সর্বদা যেতে পারি না। অফিসে এটিও’রা অছেন, তারা তো আমাকে জানাননি কিছু। আমি তদন্ত করে জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।