শিক্ষা একটি দেশের যাবতীয় উন্নয়নে পূর্বশর্ত। দেশ ও জাতির কল্যাণে শিক্ষাই প্রধান হাতিয়ার। তাই শিক্ষাকে শুধু মৌলিক অধিকার নয়, সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। একটি ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদের চেয়ে শিক্ষিত জাতির মূল্য অনেক বেশি। শিক্ষা আমাদের আচরণের ক্ষেত্রে গুণগত এবং কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন নিয়ে আসে। জাতিকে মেধায়, মননে এবং ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বমানের করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষার বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। তাই দেশের গণমানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে আমাদের অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। তবে, কেবল জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তুললেই হবে না। সেই মানুষগুলো যেনো নৈতিকভাবে সৎ, চরিত্রবান, আদর্শ ও সুনাগরিক হয়ে বেড়ে ওঠে সে চেষ্টাও করতে হবে নিরন্তর।
ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে আমাদের দেশে মাধ্যমিক স্তর বলা হয়। আট থেকে পনেরো বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীরা এই স্তরে শিক্ষা গ্রহণ করে। এই বয়স শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়সের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা খুবই চঞ্চল হয়ে থাকে। আমাদের দেশে অনুকূল আবহাওয়ার কারণে মেয়েরা আট-নয় বছর বয়সে আর ছেলেরা বারো–তেরো বছর বয়সে যৌবনপ্রাপ্ত হয়। নদীতে জোয়ার এলে যেমন দুইকূল ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
এ সময় কিশোর কিশোরীদের অবস্থাও তেমনি। সুতরাং এ বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য নৈতিক ও আদর্শিকভাবে বেড়ে ওঠার শিক্ষাক্রম প্রয়োজন। অথচ স্বাধীনতার তেপ্পান্ন বছর পার হলেও আমাদের দেশে তেমন শিক্ষাক্রম চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে অধিকাংশ মাধ্যমিক স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা এই বয়সে বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে। প্রেমের নামে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে নিজেদের ধ্বংস করে দেয়। ইভটিজিং-এর মতো ভয়াবহ অপরাধ করে সমাজে পিতামাতাকে ছোট করে দেয়। এর ফলে প্রায় ৬০ শতাংশ পিতামাতা মেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মান-সম্মান রক্ষার জন্য অনেকটা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন।
আমাদের মতে, মাধ্যমিক শাখাতেও অন্যান্য সাধারণ বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত কোরআন, হাদিস ও আরবি সাহিত্যকে পাঠ্যভুক্ত করা প্রয়োজন। কোরআন ও হাদিসের আলোকে চরিত্র গঠন, পিতামাতার প্রতি কর্তব্য, সাধারণ মানুষের অধিকার ইত্যাদি বিষয় সংযুক্ত করতে হবে। নামাজ ও রোজার বিষয়টিকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জেনার শাস্তি, চুরির শাস্তি, সুদের ক্ষতি, ঘুষের পরিণতি সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের বিধান সম্পর্কে জ্ঞান দিতে হবে। আরবি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে জোর দখল থাকতে হবে-যেনো শিক্ষার্থীরা কোরআন হাদিস সহিশুদ্ধ করে পাঠ এবং বাংলা তরজমা করতে পারে। তা ছাড়া আরবি ভাষা জানা থাকলে মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব দেশগুলোতে কাজের ক্ষেত্রেও এ ভাষা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আর আমাদের প্রিয় নবী রাসুলে কারীম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) বলেছেন, চারটি কারণে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য আরবি ভাষা শেখা বা আরবি ভাষাকে মুহব্বত করা জরুরি। ১. আল্লাহর কোরআনের ভাষা আরবি ২. রাসুলের ভাষা আরবি ৩. কবরের ভাষা আরবি ৪. জান্নাত অথবা জাহান্নামের ভাষাও আরবি।
তাই আরবি ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্য মাধ্যমিক স্তরে অন্তত দুইজন করে মওলানা শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বাংলা বা ইংরেজি ভাষার গল্পগুলোও প্রাথমিক স্তরের মতো আমাদের ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে শিক্ষণীয় হয়-এমন গল্প সংযুক্ত করতে হবে। ইতিহাস ও বিজ্ঞানেও ইসলামের স্বর্ণালি ঐতিহ্যের ইতিহাস এবং বিজ্ঞান বিষয়ে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান সম্পর্কে লেখা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শাখা চালু করে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মানসগঠন, চরিত্র ও নৈতিক শিক্ষার জন্য সৎ কাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে হবে।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি হলো আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তর। এ স্তরে যারা লেখাপড়া করেন তাদের বয়স ষোল থেকে আঠারো বছরের মধ্যে। এ স্তরের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে কবি হেলাল হাফিজের কবিতার আলোকে বলা যায় ‘এখন যৌবন যার/যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ এ বয়সের কিশোরেরা পুরাতনকে, জরাজীর্ণতাকে ভেঙেচুড়ে নতুন করে পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখে। পৃথিবীতে যতো পরিবর্তন ঘটেছে তার কৃতিত্বের একটি বড় অংশিদার এই স্তরের ছেলেমেয়েরা। মূলত এই শিক্ষাস্তরের ওপরই নির্ভর করে তাদের অনাগত ভবিষ্যৎ। আগামীতে সে কী হতে চায়? তার চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করে এই স্তরের সফলতা ও ব্যর্থতার ওপর।
সুতরাং এই স্তরের শিক্ষাক্রম এমন হওয়া উচিত যে শিক্ষাক্রমে লেখাপড়া করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পরিবর্তনটা হতে হবে অন্ধকার থেকে আলোয়, অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানে, অসৎ থেকে সৎপথে, মিথ্যা থেকে সত্যে, ধ্বংস থেকে সৃষ্টিতে, ভাঙা থেকে গড়ায়। এই শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজিসহ অন্যান্য সাধারণ পাঠের পাশাপাশি আরবি এবং কোরআন হাদিসের ওপর অন্তত দুইশত নম্বরের পাঠ্যক্রম প্রয়োজন। প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত যদি শিক্ষার্থীরা কোরআন-হাদিসের শিক্ষা পায়, হালাল-হারামের প্রকৃত জ্ঞান লাভে সামর্থ্য হয়, তবে সে আর যাই হোক, বড় হয়ে কোনো কর্মে ফাঁকি দেবে না। ঘুষ, সুদ খাবে না। অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের চিন্তা করবে না। জেনার ধারের কাছেও সে যাবে না; মদ, গাঁজাসহ কোনো প্রকার মাদক তাকে স্পর্শ করবে না-এ রকম বাস্তব উদাহরণ আমাদের সমাজে বহু রয়েছে। আজ ছেলেরা প্রেমের নামে মেয়েদের চরিত্র হরণ যখন স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করছে- জন্মদাতা পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে অথবা, নেশার টাকার জোগান না দিতে পারায় পিতামাতাকে হত্যা করছে-এদের মধ্যে একজনও কী কোরআন-হাদিস পড়েছে-এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে! যাবে না। দেশের মধ্যে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে থেকে যারা দেশের সম্পদ ও কোটি কোটি টাকা হরিলুট করছে-তাদের মধ্যে একজনও কি এমন আছে; যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড মাদরাসায় পড়া। নাহ, এমনটিও খুঁজে পাওয়া বিরল। কারণ, যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে তারা কখনো এমন অন্যায় করতে পারে না। তাই আসুন আমরা শিক্ষার সকল স্তরে কোরআন-হাদিসের শিক্ষা চালু করি।
শিক্ষার সর্বোচ্চ এবং সর্বশেষ স্তর হলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার স্তর। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ ও সিনিয়র মাদরাসাগুলোতেও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এই পর্যায়ে এসে আমরা নেতৃত্ব দানকারি মানুষ তৈরি করি। এই স্তরে এসে যিনি যে বিষয়ে পারদর্শী তিনি সেই বিষয়ে পড়ালেখা করবেন। শুধু একাডেমিক মুখস্থ পড়া বা লেখা নয়, তিনি ওই বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ হবেন। গবেষণার মাধ্যমে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য ও তত্ত্ব খুঁজে বের করবেন। যা দেশ ও সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। দেশে বেকারত্ব দূরীকরণ এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে।
যিনি কোরআন-হাদিস নিয়ে পড়াশোনা করবেন, তাকে এ বিষয় সম্পর্কে সম্মকজ্ঞান লাভ করতে হবে। তাকাওয়া অর্জন চেষ্টা করতে হবে। তাকে শুদ্ধ ও মার্জিত আচার-আচরণের অধিকারী হতে হবে। সমাজের লোকের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হবে। তিনি সমাজে ইসলামিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। যিনি বাংলা পড়বেন, তিনি এ বিষয়ে দক্ষ হবেন। তাকে একজন বিজ্ঞ সাহিত্যিক হতে হবে। যিনি ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করবেন, তিনি হবেন একজন ইতিহাসবেত্তা। যারা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়বেন, তারা যেন প্রত্যেকে বিজ্ঞানমনস্ক হন। গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রতি তাদের আগ্রহ থাকতে হবে। অর্থাৎ যিনি যে বিষয়ে পড়াশোনা করবেন, তিনি যেনো সেই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হয়ে গড়ে ওঠেন-আমাদের শিক্ষাক্রমকে এমনিভাবে ঢেলে সাজাতে হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের স্বাধীনতার তেপ্পান্ন বছর পার হলো অথচ আমাদের ছেলেরা দেশের জন্য কোনো প্রকার গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উপহার দিতে পারেনি। এ ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, দেশের শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও আদর্শিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদের একটি শক্ত কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা কমিশন সবগুলোই ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এমন কী রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করেছি। আমাদের কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। আমরা আগের জায়গাতেই রয়ে গেছি। তাই আর কালক্ষেপণ না করে আমাদের এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে, যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা একদিকে হবে সোনার মানুষ অপরদিকে তারা দেশের বোঝা না হয়ে দেশের কল্যাণে হবে এক একজন আদর্শ সৈনিক।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার আরো একটি মাধ্যম হলো কারিগরি শিক্ষা। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পর উদ্ভুত পরিস্থিতিকে সামনে রেখে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির সক্ষমতা অর্জন ও আন্তর্জাতিক মানের বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে এমন নাগরিক তৈরি করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এদেশে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়। কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে হাতে কলমে ট্রেনিং দেয়া হয়। এ ধরনের শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যেনো প্রকৃত কারিগরি ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে নিজেদের কাজে লাগাতে পারে সেইভাবে আমাদের শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, সলংগা ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, সিরাজগঞ্জ