নিজদের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি নিয়েছেন একই বাবার দুই মেয়ে। দুই শিক্ষিকার নাম তাহিরা খানম রুম্মান ও ফাতেমা জান্নাত মৌরি। তারা শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা হলেও নিজেদের হালুয়াঘাট উপজেলার বাসিন্দা দাবি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে আবেদন করে চাকরি পেয়েছেন।
তথ্য গোপন ও জালিয়াতি করে চাকরি নেয় এ দুই শিক্ষিকা শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দী ইউনিয়নের বরুয়াজানী গ্রামের আমির হোসেন খানের মেয়ে। স্থায়ী সূত্রেও শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বরুয়াজানী গ্রামের বাসিন্দা তারা। দৈনিক শিক্ষাডটকমের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে তাদের প্রকৃত পরিচয়।
সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় চাকরির জন্যে আবেদন করেছিলেন তাহিরা খানম রুম্মান। আবেদনের রোল ছিলো ১৮৫০২০৮। হালুয়াঘাট উপজেলাভিত্তিক মেধাক্রম ৫১। অপরদিকে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছিলেন ফাতেমা জান্নাত মৌরি। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষে হালুয়াঘাট উপজেলার বাহিরশিমুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পেয়ে সে বছরের ১৭ মার্চ সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তাহিরা খানম রুম্মান। আর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি একই উপজেলার পশ্চিম পাবিয়াজুড়ী চকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন অপর বোন ফাতেমা জান্নাত মৌরি।
নিয়োগ বিধিতে বলা হয়েছে, আবেদন করার সময় প্রার্থীকে বাবা বা স্বামীর ঠিকানায় আবেদন করতে হবে। প্রার্থী আবেদনে স্বামী বা বাবার ঠিকানা যেটি উল্লেখ করবেন প্রার্থীতা সেই উপজেলা বা থানার কোটায় বিবেচিত হবেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাহিরা খানম রুম্মান ও ফাতেমা জান্নাত মৌরি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বরুয়াজানী গ্রামের বাসিন্দা। দুইজনের বাবার নাম আমির হোসেন খান। উভয়েই বরুয়াজানী গ্রামের ৭নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার। তাহিরা খানম রুম্মানের ভোটার নম্বর ৮৯০৫৭১৬৭৬৩৭৮, সিরিয়াল নম্বর ০৫১৩, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ৮৯১৭০৩৮৬৭৬৩৭৮। ফাতেমা জান্নাত মৌরির ভোটার নম্বর ৮৯০৫৭১০০০১৫১, সিরিয়াল নম্বর ০৮১২, জাতীয় পরিচয়পত্র নং-(স্থানান্তরকৃত) ৬৮৮৩৩০৭৮১৮।
নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি জাতীয় পরিচয়পত্র স্থানান্তর দেখান। তবে স্থায়ী ঠিকানা শেরপুরের নালিতাবাড়ীর বরুয়াজানী গ্রামে বলে নির্বাচন কর্মকর্তা জন কেনেথ জামবিল দৈনিক শিক্ষাডটকমকে নিশ্চিত করেছেন। এদিকে দুই শিক্ষিকার স্বামীর ঠিকানাও জানা গেছে। তাহিরা খানম রুম্মানের স্বামীর বাড়ী ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় আর ফাতেমা জান্নাত মৌরির স্বামীর বাড়ী শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায়। অথচ তাহিরা খানম রুম্মান প্রকৃত স্থায়ী ও স্বামীর ঠিকানা আড়াল করে চাকরি নেন হালুয়াঘাটের ৭নং শাকুয়াই ইউনিয়নের ভাট্টা নয়াপাড়া গ্রামের পরিচয়ে ও ফাতেমা জান্নাত মৌরি হালুয়াঘাট পৌরসভার হালুয়াঘাট বাজার পূর্ব ঠিকানা দেখিয়ে। এ ক্ষেত্রে তৈরি করেন জাল নাগরিকত্ব সনদ। সনদে স্বাক্ষর দেখান তৎকালীন ইউপি সদস্য মামুন আর চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিনের। আর ফাতেমা জান্নাত মৌরি হালুয়াঘাট পৌর মেয়র খাইরুল আলম ভুঞার স্বাক্ষরিত নাগরিকত্ব সনদ দেখিয়ে চাকরির আবেদন করেন।
এদিকে স্বাক্ষর দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন ইউপি সদস্য মামুনসহ চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন।
তবে পৌর মেয়র খাইরুল আলম ভুঞা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, হালুয়াঘাট পৌরসভায় জমির কাগজ দেখানোয় ফাতেমা জান্নাত মৌরিকে নাগরিকত্ব সনদ দেয়া হয়েছে। তবে তার স্থায়ী ঠিকানা কোথায় তা বলতে পারবো না।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, এ জালিয়াতির কাজে সহযোগীতা করেন শিক্ষিকার বোন জামাতা ভাট্টা নয়াপাড়া গ্রামের এখলাস উদ্দিন মাস্টার।
শাকুয়াই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আলতাফ হোসেন বলেন, তার ওয়ার্ডে এই নামে তাহিরা খানম রুম্মান কোনো ব্যক্তি নেই। ৭নং শাকুয়াই ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের তৎকালীন ইউপি সদস্য মামুনের স্বাক্ষর জাল করে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখ দেখিয়ে তাহিরা খানম রুম্মান তৈরি করেন ভুয়া নাগরিকত্ব সনদ।
স্বাক্ষর জালিয়াতির কথা বলেন তৎকালীন শাকুয়াই ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মামুন নিজেও। মামুন বলেন, তার স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া নাগরিকত্ব তৈরি করেছেন এই শিক্ষিকা।
বাহিরশিমুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, কর্তৃপক্ষের নিয়োগ আদেশ পাওয়ায় শিক্ষিকার পরিচয় জানতে চাওয়া হয়নি। অফিস আদেশের প্রেক্ষিতে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন তাহিরা খানম রুম্মান। এদিকে শাকুয়াই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ইউনুস আলী লিখিতভাবে জানান, তাহিরা খানম রুম্মান নামে শাকুয়াই ইউনিয়নে কোনো নাগরিক নেই। চেয়ারম্যান বলেন, শিক্ষিকা নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দী ইউনিয়নের বাসিন্দা।
অপরদিকে কাকরকান্দী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান নিয়ামুল কাউসার বলেন, তাহিরা খানম রুম্মান নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দী ইউনিয়নের বরুয়াজানী গ্রামের আমির হোসাইন খানের মেয়ে। তিনি লিখিত প্রতায়নপত্রও দেন এই প্রতিবেদককে।
তৎকালীন শাকুয়াই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, স্বাক্ষর জাল করে তার ইউনিয়নের বাসিন্দা দাবি করে ভুয়া নাগরিকত্ব সনদ বানিয়ে চাকরি নেন শিক্ষিকা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে দৈনিক শিক্ষাডটকমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি অভিযুক্ত শিক্ষিকা তাহিরা খানম রুম্মান ও ফাতেমা জান্নাত মৌরি।
জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শফিউল হক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ইতোমধ্যে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদন্তে প্রমাণ পেলে তাদের দুজনেরই নিয়োগ বাতিলসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
হালুয়াঘাট উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মুঞ্জুরুল হক জুয়েল দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, দুই শিক্ষিকার বিরুদ্ধেই তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া গেছে। খুব শিগগিরই লিখিত প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হবে।