বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশই বৈদ্যুতিক গাড়ির দিকে ঝুঁকছে। গত এক দশকে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণ শিল্পে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে টেসলা, রিভিয়ান, এনআইও'র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রচলিত দ্রুতগতির গাড়ি প্রস্তুতকারক ভলভো, জিএম, নিসান এবং ফোর্ড ও বাজারে এনেছে বৈদ্যুতিক গাড়ির পসরা। বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির রেকর্ড এখন সর্বোচ্চ। নরওয়ে, জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডের মতো দেশগুলোতেও দ্রুত বাড়ছে বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার হার। বর্তমানে চীনে বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনায় ৫ বছর আগের হিসেবে সুবিশাল বাজার রয়েছে, যার হার প্রায় ২৮ শতাংশ।
আসলে বৈদ্যুতিক গাড়ি বা বাহন এমন এক ধরনের পরিবহন.. যা এক বা একাধিক বৈদ্যুতিক মোটর দ্বারা চলে এবং রিচার্জেবল ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তি ব্যবহার করে পরিচালিত হয়। ১৮৮০ দশকে প্রথম ব্যবহারিক বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি হয়েছিল।এরপর নানা গবেষণা ও অগ্রগতির পর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ব্যাটারি শক্তির উন্নতি, গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস এবং নগরীর বায়ু দূষণের মানের উন্নতি করার কারণে বৈদ্যুতিক যানবাহন উৎপাদনে একটি পুনর্জাগরণ ঘটে। বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং বিভিন্ন চার্জিং স্টেশনগুলোতে করা যেতে পারে, এই চার্জিং স্টেশন বাড়ি এবং পাবলিক উভয় জায়গায়ই স্থাপন করা যেতে পারে।
ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা বিশ্বেই বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং নানাভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আগামী এক দশকের মধ্যেই হয়তো যুক্তরাজ্যে ডিজেল ও পেট্রলচালিত গাড়ি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। পরিবেশ সুরক্ষায় উন্নত দেশগুলো ইতোমধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়..এমন যানবাহনের সংখ্যা কমানোর চিন্তা শুরু করেছে। পুরো ইউরোপ ২০৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে জ্বালানির পরিবর্তে বৈদ্যুতিক গাড়ি চালু করার কথা ভাবছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারজাত শুরু করেছে। যদিও বাংলাদেশে বিদ্যুৎচালিত ইলেকট্রিক গাড়ি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। রাস্তায় জ্বালানি তেল ও গ্যাসে চলা গাড়ির তুলনায় বৈদ্যুতিক গাড়ির সংখ্যা এখনো খুবই কম। সম্প্রতি অডি বাংলাদেশ তাদের ‘ই-ট্রোন ইলেকট্রিক এসইউভি’ দেশের বাজারে আমদানি করেছে। অনেকের ধারণা, আগামী দিনে বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজার সম্প্রসারিত হবে এবং এর ব্যবহারও বহুলাংশে বাড়বে।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে অনেক গাড়ি নির্মাতা জ্বালানি থেকে বের হয়ে বৈদ্যুতিক গাড়ির দিকে এগোচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় জার্মান অটোমোবাইল কোম্পানি বিএমডব্লিউ ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মেক্সিকোয় উৎপাদিত গাড়ির অর্ধেক বৈদ্যুতিক গাড়িতে রূপান্তরিত করতে চাচ্ছে। তবে বিএমডব্লিউ মেক্সিকোয় ইতোমধ্যেই ৩০ শতাংশ বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি করছে বলে খবরে প্রকাশ। প্রতিষ্ঠানটি জ্বালানির ব্যবহার কমাতে প্রচুর পরিমাণে পুনঃনবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে বলে মন্তব্য করেছে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৩ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং স্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে জ্বালানি চালিত গাড়ি থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি প্রতি বছর দেশটির ৩০ শতাংশ হারে চার্জিং স্টেশন স্থাপন বাড়ানোর কথা বলেছিলেন।
ভারতে বৈদ্যুতিক গাড়ির জগতে বিশ্ববিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টাটা তিন বছর আগেই এসেছে। টাটা নেক্সন ইভি নিয়েই টাটার বৈদ্যুতিক গাড়ি জগতে প্রবেশ এবং এ গাড়ি দিয়েই ক্রেতাদের নজর কেড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ভারতের বাজারে ২০২০-তে টাটা নেক্সন ইভির যাত্রা শুরু। কয়েক মাসের মধ্যেই দেশের সর্বাধিক বিক্রিত যাত্রীবাহী ইলেকট্রিক ভেহিকেলের মুকুট উঠেছে টাটা নেক্সনের এই ব্যাটারিচালিত ভার্সনের মাথায়। তারই ধারাবাহিকতায় টাটা নেক্সন ইভি ম্যাক্স নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। আধুনিক প্রযুক্তির বিদ্যুৎ চালিত গাড়ির জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কার্বন নিঃসরণ কমাতে ব্যাটারি তথা বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি বাজারে আনার কাজ শুরু করেছে। ২০১৮ থেকে কারখানার কাজ শুরু হয়েছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের কারখানাটি তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে। এটি এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ৩০ হাজার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ইলেকট্রিক গাড়ি প্রস্তুত করতে ১০০ একর জায়গা পেয়েছে। চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালিকে অংশীদার করে চলতি বছরই দেশের বাজারে বৈদ্যুতিক গাড়ি ‘পালকি’ আনতে চায় বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রতিষ্ঠানটি মূলত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তকে টার্গেট করতে চায়। গাড়ির দাম থাকবে ৭ থেকে ১৪ লাখ টাকার মধ্যে এবং কিস্তিতে টাকা পরিশোধের সুযোগ থাকবে।
বৈদ্যুতিক গাড়ির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি পরিবেশবান্ধব। তাই এটি ব্যবহারে পরিবেশের কম ক্ষতি হয়। তাই বৈশ্বিক উষ্ণতা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, কালো ধোঁয়া নির্গমন এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির কাছে আরও অনেক সমস্যার সমাধান রয়েছে। বিশ্বের মধ্যে বাষুদূষণের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান সবার শীর্ষে। তাই ঢাকার মতো শহরের জন্য বৈদ্যুতিক গাড়ি বড় সুবিধা হতে পারে। পরিবেশের সুরক্ষার কথা চিন্তা করলে প্রচলিত জ্বালানি চালিত গাড়ির চেয়ে বৈদ্যুতিক গাড়ি অনেক ভালো। তাছাড়া, দক্ষতার দিক দিয়েও বৈদ্যুতিক গাড়ি অনেক এগিয়ে। বৈদ্যুতিক মোটর ইন্টারনাল কমবাসশনে চলা ইঞ্জিনগুলোর চেয়ে বেশি কার্যকর অর্থ্যাৎ একই পরিমাণ শক্তি নিয়ে বৈদ্যুতিক গাড়ি অনেক বেশি দূরত্বে যেতে পারে। বৈদ্যুতিক গাড়ি এক রাতেই সম্পূর্ণ চার্জড হয়ে যায়। তাই সকালে কোনো ফুয়েল স্টেশনে না গিয়েই গন্তব্যে যাত্রা শুরু করা যায়। গাড়ি কেনার সময় প্রথম যে চিন্তা মাথায় আসে, তা হলো গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানির খরচ। এসব দিক বিবেচনা করে বৈদ্যুতিক গাড়ির খরচ তুলনামূলক কম। বর্তমানে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির ধারণ ক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এক দশক আগেও যেখানে বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলো একবার চার্জে মাত্র ৭০ মাইল দূরত্ব চলতে পারতো, এখন বেশিরভাগ গাড়ি ২০০ থেকে ৩০০ মাইলেরও বেশি চলতে পারে।
তাছাড়া, গবেষণায় দেখা গেছে, গ্যাস চালিত যানবাহনের তুলনায় বৈদ্যুতিক গাড়ির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রায় অর্ধেক। একটি বৈদ্যুতিক গাড়ির জীবনদ্দশায় এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ সাড়ে চার হাজার মার্কিন ডলার, যা গতানুগতিক গাড়ির তুলনায় অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন বা ব্যবহৃত যে কোনো বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির ট্যাক্স বিল, গ্যাস চালিত গাড়ির তুলনায় কম। ব্যাটারির ধারণ ক্ষমতা ও সরকারি নীতির ওপর নির্ভর করে ট্যাক্সের পরিমাণ সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ হাজার ডলার।
তবে বৈদ্যুতিক গাড়ির কিছু অসুবিধা বা নেতিবাচক দিকও আছে। ভোক্তাদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্যাসচালিত গাড়ির তুলনায় বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম ১০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। যদিও গতানুগতিক গাড়ির তুলনায় বৈদ্যুতিক গাড়ির অন্য সব খরচ সীমিত ও এটি পরিবেশবান্ধব, তবে এর এককালীন ক্রয়মূল্য অনেক বেশি।
এছাড়া, গ্যাসচালিত গাড়ির তুলনায় বৈদ্যুতিক গাড়ি দ্রুত মূল্য হারাতে থাকে। অর্থাৎ, দ্বিতীয়বার বিক্রির সময় প্রচলিত গাড়ির চেয়ে ব্যাটারিচালিত গাড়ির মূল্য অনেক কমে যায়। তবে এটি গাড়ি বিক্রেতাদের জন্য দুঃসংবাদ হলেও ক্রেতাদের জন্য সুসংবাদ। ব্যবহৃত গ্যাস চালিত গাড়ির তুলনায় যৌক্তিক মূল্যে ক্রেতারা বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনতে পারবেন। আবার, বৈদ্যুতিক গাড়ির জ্বালানি ‘ইগ্যালনের’ দাম গ্যাসের দামের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। তবে এখানে রয়েছে কিছু এককালীন খরচ। ব্যাটারি চার্জ হতে সময় লাগে অন্তত ৮ থেকে ১৪ ঘণ্টা এবং বড় গাড়ির ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার বেশি। তাছাড়া, গাড়ির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চার্জিংয়ের সময়ও বাড়তে থাকে।
গাড়ি কেনার পর বড় চিন্তার বিষয় হচ্ছে..জ্বালানি খরচ ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়। আর যত সময় যায়, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ আরও বাড়তেই থাকে। গাড়ির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণের খরচও বেশ বাড়তে থাকে। তবে বৈদ্যুতিক গাড়ির কিছু ক্ষেত্রে এসব খরচ অনেক কম। তবে কিছু দৈনন্দিন খরচ, যেমন অটো বিমা, কাঠামোগত মেরামত, ব্রেক, টায়ার পরিবর্তন ইত্যাদি আইসিই এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একজন যে গাড়িই ব্যবহার করুক না কেনো, তাকে এসব ব্যয় বহন করতেই হবে।
বর্তমানে ঢাকা শহরে তেমন কোনো বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করার বাণিজ্যিক চার্জিং স্টেশন নেই। তাই বৈদ্যুতিক গাড়ির মালিকদের গাড়ি চার্জ দেওয়ার কাজটা কঠিন মনে হয়। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এ বিষয়গুলো সহজলভ্য হলে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার আরও বাড়বে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকার নতুন একটি অটোমোবাইল নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যার লক্ষ্য পরিবেশবান্ধব যানকে পরিবহন ব্যবস্থায় বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করা। ২০৩০ নাগাদ অন্তত ১৫ শতাংশ নিবন্ধিত বৈদ্যুতিক গাড়ির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০২০-এর খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, জ্বালানি সাশ্রয়ী যানবাহন (ইইভি) প্রস্তুতের পেছনে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর অবকাশের (ট্যাক্স হলিডে) সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিও ইতোমধ্যে এসব গাড়ির নিবন্ধন দিতে শুরু করেছে।
তবে বৈদ্যুতিক গাড়ি ক্রয়ের সময় ব্যাটারির বিষয়ে একটু সচেতন হতে হয়। বৈদ্যুতিক গাড়িতে ব্যাটারি থাকে। ব্যবহার করার ফলে গাড়ির ব্যাটারি প্যাকটি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয় এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে এটি এক বিরাট বড় ধাক্কা। প্রতিনিয়ত চার্জ দেওয়ার ফলে ব্যাটারিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তখন ব্যাটারি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। তবে সময়ের প্রয়োজনে বাড়ছে পরিবেশ বান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা ও আগামীতে এরাই রাস্তা দখল করবে।
লেখক : মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার