‘ক’ রহমান ‘গ’ শিক্ষাবোর্ডের ইংরেজির প্রধান পরীক্ষক। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরও পরীক্ষক। এমনকি তিনি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কঠিন প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষারও খাতা দেখেন! স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এসব পরিচয়ের ব্যবসায়িক ও সামাজিক ব্যবহার হামেশাই চোখে পড়ে। কেউ বিজনেস কার্ডে এই পরিচয় ব্যবহার করেন। আবার কেউ সহায়ক বইয়ের নামে চলা নিষিদ্ধ নোট-গাইডেও মোটা অঙ্কের বিনিময়ে পরিচয় ছাপানোর সুযোগ দেন।
পত্রিকার পাতাজুড়ে যেসব নোট-গাইড নিত্যদিনই প্রকাশিত হচ্ছে সেগুলোতেও দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের নামে সঙ্গে এসব তকমা যুক্ত। আবার কোনো কোনো পরীক্ষক ব্যবসা জমাতে বাড়ির নেমপ্লেটে কিংবা কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ডেও এসব পরিচয় দিয়ে থাকেন। যারা আরো বড় করে জানান দিতে চান, তারা তো রীতিমতো বাড়ির সামনে সাইনবোর্ডই গেঁড়ে রাখেন। সেসব বোর্ডে রঙের বাহারি ব্যবহারও নজর কাড়ে।
বিসিএস কোচিংগুলোতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতে গিয়ে কেউ কেউ বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলে থাকেন, ‘আপনারা যে বিসিএস পরীক্ষা দেন আমি কিন্তু সেই খাতাও দেখি।’
যদিও এহেন অভিযোগ সব শিক্ষকের বিরুদ্ধে নয়। নানা কারণে কেউ কেউ বোর্ডের পরীক্ষক হতেও চান না। আবার অনেক গুণী শিক্ষককে আমি চিনি-জানি, যারা বোর্ড বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা বিসিএস খাতা দেখেন, কিন্তু সাইনবোর্ড তো দূরের কথা, নিজ সন্তানের সঙ্গেও খাতা দেখা নিয়ে কোনো আলোচনা করেন না। অর্পিত পবিত্র দায়িত্বটা অতি গোপণীয়তা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন তারা।
আসছে পনেরো ফেব্রুয়ারি শুরু এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এর পরের ধাপ পরীক্ষক নিয়োগ ও উত্তরপত্র মূ্ল্যায়ন পর্ব। তাই মনে হলো, এখনই প্রধান পাবলিক পরীক্ষার পরীক্ষকদের বিষয়ে কিছু লেখা উচিত। এমন ভাবনা থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দৈনিক শিক্ষাডটকমের মহাফেজখানা থেকে বের করে দেখে নিলাম শিক্ষাবোর্ডের পাবলিক পরীক্ষার পরীক্ষক নিয়োগের ২৯ দফা শর্ত।
১ নং শর্তে বলা হয়েছে … তারিখে পরীক্ষকগণের প্রশিক্ষণে অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন। প্রশিক্ষণে উপস্থিত না থাকলে উত্তরপত্র দেয়া হবে না।
৬ নং শর্তাংশ এমন: … উল্লেখ্য, চাকুরি এবং পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো প্রকার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পরীক্ষক হিসেবে উত্তরপত্র গ্রহণ করলে আপনাকে দোষী বলে গণ্য করা হবে এবং আপনার বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০ (সংশোধিত) ১৯৯২ অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১০ নং শর্তটা এমন : বোর্ড অফিস হতে উত্তরপত্র গ্রহণ করার পর মূল্যায়ন শেষে প্রধান পরীক্ষকের নিকট পাঠানো পর্যন্ত উত্তরপত্র গুলো অতীব যত্ন সহকারে নিজ হেফাজতে রাখা এবং পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করা আপনার পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এরপর ফোন দিলাম কয়েকটা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা শাখার কয়েকজন বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে। একজন বললেন, ‘লিখিত শর্ত ছাড়াও পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আদেশ-নিষেধ বলে দেয়া হয়।’
তো লিখিত-মৌখিক নিদেশ কতটা মানছেন আমাদের পরীক্ষকরা? একটু চোখ বোলাই গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক আমাদের বার্তায় প্রকাশিত ‘এইচএসসির খাতা অবৈধ কোচিংয়ের হাতে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ‘এইচএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষার খাতা নিয়ে ‘ছিনিমিনি খেলার’ অভিযোগ উঠেছে মো. আবু তাহের নামে এক পরীক্ষকের বিরুদ্ধে। তিনি তার অবৈধ কোচিংয়ে পড়তে আসা রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রীদের দিয়ে ওই খাতাগুলো মূল্যায়ন করিয়েছেন।
জানা গেছে, শিক্ষক মো. আবু তাহের রাজধানীর বাড্ডার ন্যাশনাল কলেজে কর্মরত। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ইংরেজি বিষয়ের সিনিয়র প্রভাষক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজির পরীক্ষক।
ওই শিক্ষকের কোচিং শিক্ষার্থীদের দিয়ে এইচএসসির খাতা দেখানোর এ ঘটনা নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষা বোর্ডগুলোতে গত কয়েকদিন ধরে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। অসন্তোষ চলছে নটরডেম কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ন্যাশনাল কলেজেও।”
পাঠক, মাত্র দুই দশক আগের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলেই এ লেখাটি শেষ করছি। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের কথা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ইংরেজির অধ্যাপক খোন্দকার আবদুল হান্নানের ইন্টারভিউ করতে গেলাম। দেখলাম, উনি খুব ব্যস্ত। টেবিলের ওপরে অনেকগুলো উত্তরপত্র। কৌতুহলী ও সতর্কভাবে দেখে নিলাম কীসের খাতা। আড্ডা জমতে জমতে পরিচালক নিজে নিজেই বলা শুরু করলেন, প্রতিবারই আমি পিএসসির খাতা দেখি, তবে এবার আমাকে অনেক বেশি খাতা দিয়েছে। এবার নাকি লিখিত পরীক্ষায় পাস অনেক বেশি।
অধ্যাপক আবদুল হান্নানের কাছ থেকে আরো বিস্তারিত তথ্য নিয়ে বেরিয়ে ফোন দিলাম আমার তৎকালীন বস ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের উপ-সম্পাদক নূরুল কবীরের কাছে। তাকে জানালাম, যেসব বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম পরিচালকের কাছে তার চাইতে অন্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এবং যাচাইবাছাই করার সময় পেলে আজই একটা দারুন রিপোর্ট দিতে পারি। তার নির্দেশ পেয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক জেড এন তাহমিনা বেগমের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বারবার জানতে চাইলেন, আমি কোন পরীক্ষকের কাছে এতো খাতা দেখেছি? খাতা তো গোপনীয় বিষয়, আপনি [সাংবাদিক] কেন তা দেখেছেন? এখন আবার এ নিয়ে রিপোর্ট করতে হবে কেনো…. ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। যাই হোক, পরদিন বড় করে ছাপা হলো খবরটি। যতদুর মনে পড়ে, এতো বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় পাস করানোর ঘটনা সেবারই শেষ। আমার রিপোর্টের পর পরীক্ষক ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে অনেক নিয়ম-নীতি করা হয়েছিলো।
পাঠক,
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সাহেব শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে গত পাঁচ বছর গভীরভাবে ভেতরে থেকে শিক্ষার নানাদিক দেখেছেন, বুঝেছেন। বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব পেয়েই কয়েকটি সংস্কারমূলক কাজ করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। পাবলিক পরীক্ষার হলে না ঢোকার ঘোষণা দিয়েছেন। পরীক্ষাসংশ্লিষ্টতা না থাকা অন্যদেরও না ঢোকার জন্য বলেছেন। এক ঘোষণায় পুরো জাতির কাছে প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।
আশা করি, তার সক্রিয় তত্ত্বাবধানে পরীক্ষকদের পরীক্ষক পরিচয়ে কোচিং-টিউশনি-নোট-গাইডবাণিজ্যের অবসান ঘটবে।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।