বাপরূপী দুহিতাদের ভাগ্য ভালো হয়- এমন কথা সেই ছেলেবেলা থেকে মুরুব্বীদের মুখে শুনে আসছি। রহমত দুহিতার ভাগ্যটাও ভালো বলতেই হবে। সংসদ সদস্য হিসেবে কনিষ্ঠতমদের অন্যতম হয়েও মন্ত্রণালয় হিসেবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণটিই পেয়েছেন।
যার প্রসঙ্গে এই কথামালার অবতারণা তিনি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানের স্বনামখ্যাত এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। যদিও তার সঙ্গে কখনো পরিচিত হওয়ার মওকা মেলেনি। তবে, আমার একাধিক সহকর্মী বহুবার তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরির জন্য শিক্ষায়তনটিতে গেছেন। সুতরাং দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবার তার সঙ্গে পরিচিত। সপ্তাহ চারেক আগে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর বেশ কয়েকবার তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি ও ভিডিয়ো দেখেছি। তীব্র শীতে সঠিক সময়ে কয়েকটি জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা কার্যকর করে ইতোমধ্যেই শিক্ষাখাতের সুলুকসন্ধানীদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
তবে, যতোবারই তার কোনো কর্মসূচির কথা শুনি, কেনো যেনো তার পিতার মুখখানিই ভেসে ওঠে। সংসদ বিষয়ক প্রতিবেদক থাকার সুবাদে তার পিতা পাঁচবারের এমপি অ্যাডভোকেট রহমত আলীর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছে অসংখ্যবার। সফেদ পাঞ্জাবি পরিহিত দৃঢ়চেতা ও আত্মবিশ্বাসী একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষ। জাতীয় সংসদ ভবনে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর কক্ষের সামনে দিয়ে তার নিজের কক্ষের দিকে হেঁটে যাওয়ার পথিমধ্যে আমাদের সংসদ বিষয়ক সাংবাদিক সমিতির অফিসের সামনে একটু দাঁড়াতেন। ভেজানো দরোজাটি ঠেলে জানতে চাইতেন, আমরা কারা আছি এবং কেমন আছি। তার কণ্ঠ শুনে সম্মান জানাতে কাজ ছেড়ে উঠে গিয়ে কুশলাদি বিনিময় ও তার স্বাস্থ্যের খবর নিতাম। কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো একটু সময় বসে আবার নিজ গন্তব্যে চলে যেতেন। আমরা সংসদ বিটের কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক তাকে রহমত চাচা সম্বোধন করতাম। অধিবেশন কক্ষে, নিজ কক্ষে ও সংসদের বিভিন্ন ফ্লোরে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সুখস্মৃতি অনেক। তবে সমিতির বারান্দার সামনে দিয়ে তাঁর হেঁটে চলার দৃশ্যটিই আমার চোখে বেশি ভেসে ওঠে। রহমত চাচার নাম শুনলেই সেই চেহারাটা জাগে মনের আয়নায়।
প্রয়াত সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী রহমত দুহিতা রুমানা আলী প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলার আগে শুক্রবার দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ প্রকাশিত ‘প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা পরিদর্শন করলেন প্রতিমন্ত্রী’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি এক ঝলক দেখে নিই।
“ময়মনসিংহে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা পরিদর্শন করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী। শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং সরকারি আনন্দমোহন কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন তিনি।”
“প্রতিমন্ত্রী কেন্দ্র দুটির পরীক্ষাকালীন বিভিন্ন কক্ষে প্রবেশ করেন এবং সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ সময় ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী, ময়মনসিংহ বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলী রেজা, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (শিক্ষা ও আইসিটি) মাহফুজুল আলম মাসুমসহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।”
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেন, লেখালেখি করে শিক্ষামন্ত্রী-শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবসহ শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মাধ্যমে শিক্ষাখাতে বেশকিছু গুণগত পরিবর্তনের সঙ্গে বা পেছনে দৈনিক শিক্ষাডটকম ডিজিটাল পত্রিকা ও এর উদ্যোক্তাদের ভূমিকা রয়েছে।
বিভিন্ন সরকারের সময়ে যেসব বিষয় নিয়ে বহু লেখালেখি, ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও সচিত্র প্রতিবেদন করেছি সেগুলোর অন্যতম হলো- পাবলিক পরীক্ষার হলে ডজন ডজন ফটো সাংবাদিক ও ক্যামেরাপারসন নিয়ে মন্ত্রী-সচিব-ডিজি-চেয়ারম্যান, এমনকি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তারও ক্লিক ক্লিক শো ডাউন। এবং পরীক্ষাসন্ত্রস্ত জাতি হিসেবে পরিচিত এ দেশটির কোমলমতি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে অতি গুরুত্বপূর্ণ মিনিটগুলোর ক্ষতি প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা।
যতো দূর মনে পড়ে, বিএনপি-জামায়াত জমানায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলনের সময়ে সদলবলে পরীক্ষার হলে ফটোসেশন ও ঢোকাকাণ্ড স্থায়ী রূপ পায়। তিনি যখন প্রতিমন্ত্রী তখন আমি ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের শিক্ষা ও সংসদ বিষয়ক সিনিয়র রিপোর্টার। পরীক্ষার হলে ঢুকে ফটোসেশন করা ও পরীক্ষার্থীর মাথায় হাতবুলিয়ে দেয়া বা পরীক্ষা কেমন হচ্ছে তা জানতে চাওয়ার অঘটনগুলো নিয়ে প্রায়ই কথা বলতাম মিলন সাহেবের সঙ্গে। তার জবাবগুলো মোটামুটি একই ধরনের--- নকলের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল ইত্যাদি।
বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষার্থীদের ক্ষতি নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদনও লিখেছি। এসব নিয়ে নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবীর কড়া ভাষায় সম্পাদকীয়ও লিখেছেন।
২০০৭ ও ২০০৮ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে দুইজন শিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। প্রথমজন সাবেক আমলা আইয়ুব কাদরী। তিনি নিজে ঢুকেছিলেন কি-না স্পষ্ট মনে নেই, তবে তার সময়ে শিক্ষাসচিব ও বোর্ড চেয়ারম্যানরা পরীক্ষার হলে ঢুকেছেন, ফটোসেশন করেছেন। অপরজন, অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ভাই। উপদেষ্টা হওয়ার বহু আগে থেকেই তার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। তাই তিনি ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার হলে শিক্ষার বড় কর্তাদের ফটোসেশন ও তাতে কোমলমতি পরীক্ষার্থীদের অতি গুরুত্বপূর্ণ মিনিটগুলোর ক্ষতি প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।
নুরুল ইসলাম নাহিদ ভাইকে প্রথম কিছুদিন বোঝাতে সক্ষম ছিলাম বটে। মন্ত্রীত্বের দুই এক বছরের মধ্যে যখন তিনি শিক্ষাসচিবসমেত ক্যামেরাক্রেজি হয়ে উঠলেন তখন আমিও আমার কলম চালালাম দুহাতে। রিপোর্টার হিসেবে নিউ এইজ পত্রিকায় এবং সম্পাদক হিসেবে ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ।
সময় আরো গড়ালো। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর মো. নজরুল ইসলাম খানকে শিক্ষাসচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সরকারি আদেশ জারি হলো। পুরো প্রস্তুতি নিয়ে পেছনের ইতিহাস তাকে জানালাম। তার ভাবনাও দেখা গেলো, ইতিবাচক। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর [শেষ কর্মদিবস] অব্দি যতোগুলো পাবলিক পরীক্ষা গেছে কোনোটিতেই পরীক্ষার হলে শিক্ষাসচিব এন আই খানকে কেউ দেখেননি। সাংবাদিকদের দিয়ে প্রশ্ন করিয়েছি, মন্ত্রীসহ সবাই হলের মধ্যে আর আপনি কেনো বারান্দায়? তার উত্তর দৈনিক শিক্ষাডটকমসহ বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। এমন সাহসি ও শিক্ষা সংস্কারক সচিবের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেবের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন দেখেছি। ইবতেদায়ী থেকে শুরু করে হেন পরীক্ষা নেই যে তিনি সদলবলে দেখতে যাননি। তবে, সমালোচনার মুখে কিছুটা সংযমী হয়ে ফটোসেশনগুলো তিনি হলের বারান্দায় করা শুরু করেন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে মন্ত্রী হিসেবে নাহিদ সাহেবের বিদায়ের পর গত পাঁচ বছর আপনারা দেখেছেন ডা. দীপু মনির মন্ত্রীত্বকাল। তিনিও সংযমের ধারাটি রক্ষা করে গিয়েছেন।
হঠাৎ করেই ছন্দপতন ঘটিয়েছেন আমাদের অতি প্রিয় প্রয়াত রহমত চাচার শিক্ষক কন্যা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী।
বলা হয়, এসএসসি-এইচএসসিসহ যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার চেয়ে মানুষের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ চাকরির পরীক্ষা। তাই অনিয়ম ও দুর্নীতি বেশি করার প্রবণতা নিয়োগ পরীক্ষায়ই। তাহলে নিয়োগ পরীক্ষা হলের এক সেকেন্ডে সমান এসএসসি পরীক্ষার হলের পাঁচ মিনিট বললে কি বেশি বলা হবে? আর ফটোসেশন মানেই তো বহু সেকেন্ড বা একাধিক মিনিটের ব্যাপার। মাননীয় মন্ত্রীর মহামূল্যবান সেই ফটো সেশনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কালে সংশ্লিষ্ট কক্ষগুলোর পরীক্ষার্থীদের ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে হিসেব কষে দেখুন তো একবার। যেখানে পরীক্ষাটির ব্যাপ্তিকাল মাত্র এক ঘণ্টা।
আশা করি. শিক্ষাবিষয়ক দেশের একমাত্র জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকার এ ক্ষুদ্র লেখাটি নতুন প্রতিমন্ত্রীর নজরে আসবে। তিনি নিজেই রুখে দেবেন নিয়োগসহ গুরুত্বপূর্ণ সব পরীক্ষার হলে ফটোসেশন এবং পরীক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ‘সময় নষ্টকাণ্ড’। আর তা দেখে শিক্ষা নেবেন অধস্তনরা।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও সম্পাদক, দৈনিক শিক্ষাডটকম
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।