পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর স্বার্থে প্রত্যয় স্কিম বাতিল করুন - দৈনিকশিক্ষা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর স্বার্থে প্রত্যয় স্কিম বাতিল করুন

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ রূপকল্প ২০৪১ অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অতিক্রম করেছে। পেনশন বা বিশেষত বৃদ্ধ বয়সে আয়-উপার্জনহীন নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সর্বজনীন পেনশন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে আগে থেকেই পেনশনের অধীনে থাকা স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত বা আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় প্রত্যয় স্কিম চালুর বিষয়টি জনমনে একপ্রকার সন্দেহের উদ্রেক করেছে। গত মার্চে সরকার এক প্রজ্ঞাপন জারি করে, যেখানে আগামী ১ জুলাই থেকে প্রত্যয় স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। বিষয়টি বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিপুলভাবে সমালোচিত হচ্ছে। স্কিমটি ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি এ ব্যাপারে তাদের আপত্তির কথা সরকারকে জানিয়ে আসছে। তাদের শঙ্কা স্কিমটি চালু হলে মেধাবীরা উপযুক্ত প্রণোদনা ও পেশাগত সুবিধার অভাবে দেশের  উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে যোগদানে আগ্রহ হারাবেন। তখন ক্রমাগত আর্থিক ও পেশাগত সুযোগ-সুবিধার সংকটে ভুগে  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হতে পারে বেসরকারি কলেজে। রোববার (১৯ মে) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তধ্য জানা যায়।

উল্লেখ্য, গত ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের ইশতেহারে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সর্বজনীন পেনশনের যে রূপরেখা হাজির করেছিল, তাতে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা– চারটি স্কিমের উল্লেখ ছিল; প্রত্যয়ের কোনো উল্লেখই ছিল না। কারণ দলের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পেরেছিলেন, জনগোষ্ঠীর যে অংশ ইতোমধ্যে একটি পেনশন ব্যবস্থার মধ্যে আছে, তাদের জন্য নতুন কিছু করা নিষ্প্রয়োজন। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসেও পেনশন-সংক্রান্ত যে প্রজ্ঞাপন জারি হয়, তাতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য আলাদা পেনশন স্কিমের কোনো উল্লেখ ছিল না। 

প্রত্যয় স্কিমের প্রথম সমস্যা হলো–এর আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যাওয়া কর্মীর পেনশন প্রতি মাসে বাড়তে পারে, আবার কমতেও পারে। অথচ একই সময়ে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী নির্দিষ্ট হারে মাসিক পেনশন পাবেন; তা আবার ফি বছর পাঁচ শতাংশ করে বাড়বে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যয়ে কোনো কর্মী অবসরজনিত সুবিধা বা আনুতোষিক পাবেন না; অর্জিত কিন্তু অভোগকৃত ছুটি নগদায়নও করতে পারবেন না; অথচ সরকারি চাকরিজীবীরা এর সব পাবেন। তৃতীয়ত, প্রচলিত নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীরা সর্বনিম্ন পাঁচ বছর চাকরি করলে তাদের অক্ষমতাজনিত অবসর বা মৃত্যুর পর তাদের পরিবারের সদস্যরা নির্ধারিত হারে মাসিক পেনশন প্রাপ্য হন; অথচ প্রত্যয় স্কিমের আওতায় ১০ বছরের কম চাকরিকাল হলে তারা শুধু জমাকৃত অর্থ ও এর মুনাফা এককালীন প্রাপ্য হবেন। চতুর্থত, ১ জুলাই ২০২৪ থেকে পারিবারিক পেনশনের আওতায় অবসরভোগী সরকারি কর্মীর অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী কিংবা প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন পাবেন। এমনকি তাঁর অবিবাহিত কন্যারাও এর কিছু সুবিধা পাবেন। পারিবারিক পেনশন প্রাপ্তির সঙ্গে মূল অবসরভোগীর বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই।  

অথচ প্রত্যয় স্কিমের আওতায় অবসরভোগী কর্মী ৭৫ বছর বয়সে মারা গেলে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য আর কোনো সুবিধা পাবেন না। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর; আর নারীদের ৭৪ বছর। আশা করা যায়, সামনের দিনে তা আরও বাড়বে। ফলে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে টেকসই সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের আওতাভুক্ত করার যে অঙ্গীকার পেনশন আইনে ব্যক্ত করা হয়েছে, প্রত্যয় স্কিমে তার কোনোই প্রতিফলন নেই। পঞ্চমত, প্রত্যয় স্কিম ১ জুলাই ২০২৪ থেকে যোগদান করা কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকদের সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে কোনো পদেই সম্পূর্ণ নতুন নিয়োগ সম্ভব। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকরা যখন আগামী জুলাই থেকে একই বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো শূন্য পদে যোগ দেবেন, তাদেরও প্রত্যয় স্কিমের অধীনে যেতে হবে। তার মানে স্কিমটি চালু হলে একই সময়ে যোগদান করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মী পুরোনো নিয়মে বেশি সুবিধার আর অন্যরা প্রত্যয়ের অধীনে সীমিত সুবিধার পেনশন প্রাপ্য হতে পারেন। প্রত্যয় কী সাংঘাতিক! এমনিতেই সামরিক-বেসামরিক আমলাদের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেশাগত সুবিধা কত কম তার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় ইচ্ছুক মেধাবীদের নিরুৎসাহ করতে চাই না। তবে অধ্যাপনায় এসে যেন পরে হাপিত্যেশ না করেন সে জন্য জানাই–একজন মধ্যম সারির আমলার ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য মাসিক যে অর্থ বরাদ্দ, তার প্রায় সমপরিমাণ অর্থ মধ্যম সারির অধ্যাপকরা মাস শেষে বেতন হিসেবে পান। বৈষম্য এখানেই সীমাবদ্ধ নয়।

সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একই গ্রেডের মূল বেতনে যোগদান করেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যোগ্যতা অনুযায়ী একাধিক ইনক্রিমেন্ট পেতেন। এখন তা পুরোপুরি বন্ধ। চাকরিরত সরকারি কলেজের শিক্ষকরা পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করলে পান তিনটি, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পান দুটি ইনক্রিমেন্ট। সামরিক-বেসামরিক আমলা, বিচারক, এমনকি সরকারি কলেজের শিক্ষকরাও যেখানে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় অধিকতর নিরাপদ অবসর যাপনের নিশ্চয়তা পাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সেখানে সীমিত অবসর সুবিধায় সন্তুষ্ট থাকতে হবে। 

প্রত্যয় স্কিম বাস্তবায়িত হলে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন পন্থা আবশ্যিকভাবে অবলম্বন করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নিজেদের আয় বাড়ানো। এর সহজতম উপায় শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপিত বর্ধিত বেতন-ফি। তবে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আয় যতটুকু বাড়ায়, মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদেয় মোট বরাদ্দ ততটুকুই প্রতিবছর কমিয়ে দেয়। অতএব শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি বাড়িয়েও লাভ হবে না। এদিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কিছুটা বেসরকারি কলেজগুলোর মতো; যেখানে মন্ত্রণালয় একদিকে বিভিন্ন ফি নির্ধারণ করে দেয়, আবার সীমিত সামর্থ্যে উঁচুমানের শিক্ষার আবদারও করে। আবার বেতন-ফি বাড়ালেও তৈরি হবে নতুন সংকট: স্বল্প ব্যয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ সংকুচিত হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাধ্য হবে বিদ্যমান অন্তর্ভুক্তিমূলক দর্শনকে পরিত্যাগ করতে । 

তাই সরকারের কাছে নিবেদন–দেশের উচ্চশিক্ষার স্বার্থে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচানোর স্বার্থে সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিমটি অবিলম্বে বাতিল করুন।  

লেখক: মামুন আল মোস্তফা ও আবু হোসেন মুহম্মদ আহসান, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শিক্ষাখাতের নতুন তদবিরবাজ তিতাস! - dainik shiksha শিক্ষাখাতের নতুন তদবিরবাজ তিতাস! শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে: সমন্বয়ক হান্নান - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে: সমন্বয়ক হান্নান তদন্ত রিপোর্ট না দিয়েই সটকে পড়ছেন শিক্ষা পরিদর্শকরা - dainik shiksha তদন্ত রিপোর্ট না দিয়েই সটকে পড়ছেন শিক্ষা পরিদর্শকরা বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষা বোর্ডের সেই সচিব নারায়ণ নাথ - dainik shiksha বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষা বোর্ডের সেই সচিব নারায়ণ নাথ আমরা চাই না ছাত্রদের কঠোর হয়ে দমন করতে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা - dainik shiksha আমরা চাই না ছাত্রদের কঠোর হয়ে দমন করতে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034220218658447