মরক্কোর ধনী পরিবারের মহীয়সী নারী ফাতিমা আল-ফিহরি মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষায় ব্যাপক অবদান রেখেছেন। নবম শতকে তিনি মরক্কোর ফেজ শহরে গড়ে তোলেন বিখ্যাত কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়। ইউনেসকো ও গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে এখনো পাঠদান করা হয়। বিশ্বসেরা অনেক মুসলিম পণ্ডিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
আনুমানিক ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরে ফাতিমা আল-ফিহরির জন্ম। বাবা মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আর্থিক টানাপোড়েনে ছিলেন। ফাতিমার জন্মের পর জীবিকার সন্ধানে মরক্কোর ফেজ শহরে পাড়ি জমান। সেখানে নিজেকে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। দুই মেয়ে ফাতিমা ও মারইয়ামকে আরবি ভাষা, ফিকহ ও হাদিস শাস্ত্রের শিক্ষা দেন। পড়াশোনা শেষ করে ফাতিমা শিক্ষার বিস্তারে মনোনিবেশ করেন।
ফেজ শহরের এক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে ফাতিমার বিয়ে হয়েছিল। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কিছুদিনের মধ্যেই ফাতিমার বাবা, স্বামী ও ভাই মারা যান। রয়ে যান শুধু দুই বোন—ফাতিমা ও মারইয়াম। ফলে উভয়েই বিপুল সম্পদের মালিক হন। সেই সম্পদ ফাতিমা মুসলমানদের শিক্ষার উন্নয়নে ব্যয় করার পরিকল্পনা করেন। দরিদ্র ও অভাবী শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিয়ে পড়াশোনা করাতে থাকেন। এ কারণে ফাতিমা মানুষের মাঝে ‘উম্মুল বানিন’ বা ‘সন্তানদের মা’ হিসেবে পরিচিতি পান।
কারাউইন মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা
৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ফাতিমা আল-ফিহরি ফেজ শহরে প্রতিষ্ঠা করেন সেকালের আফ্রিকা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় কারাউইন মসজিদ। মসজিদ নির্মাণের কাজ তিনি নিজেই তদারক করতেন। ইবনুল আরাবির বর্ণনা থেকে জানা যায়, মসজিদ নির্মাণের দিনগুলোতে তিনি রোজা অবস্থায় ছিলেন। জন্মভূমি কাইরাওয়ানের সঙ্গে মিল রেখে মসজিদের নাম কারাউইন রেখেছিলেন।
মসজিদের সঙ্গে ফাতিমা একটি মাদ্রাসাও নির্মাণ করেন। সেখানে ইসলাম শিক্ষা, আরবি ব্যাকরণ, গণিত, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, রসায়ন, ভূগোলসহ অসংখ্য বিষয়ে পাঠদান করা হতো। দশম শতাব্দী থেকে মাদ্রাসাটির খ্যাতি আফ্রিকা ছাড়িয়ে ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আশপাশের অনেক দেশ থেকে এখানে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন এবং কারাউইন মাদ্রাসা আফ্রিকা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়ছিল, যা এখনো আফ্রিকার বুকে সগৌরবে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে চলেছে।
কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়
ইউনেসকো ও গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী কারাউইনই বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যা এখন পর্যন্ত একাধারে চালু আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে মরক্কোর ফেজ শহর আফ্রিকার শিক্ষা-দীক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়। শুধু মুসলমান নন, মধ্যযুগের অনেক খ্যাতিমান ইহুদি, খ্রিষ্টান মনীষীও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিখ্যাত মালিকি বিচারপতি ইবনুল আল-আরাবি, ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন, বিজ্ঞানী ইবনে রুশদ ও জ্যোতির্বিদ নুরুদ্দিন আল-বিতরুজি।
কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিকেও বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরি বিবেচনা করা হয়। আগুনে পুড়ে বিপুলসংখ্যক পাণ্ডুলিপি নষ্ট হওয়ার পরেও এতে প্রায় ৪ হাজার প্রাচীন ও দুর্লভ পাণ্ডুলিপি আছে। এর মধ্যে আছে নবম শতকে লেখা কোরআন শরিফ, হাদিসের সংকলন, ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, ইবনে ইসহাকের লেখা রাসুল (সা.)-এর জীবনী, ইবনে খালদুনের কিতাবুল ইবার এবং আল-মুকাদ্দিমার মূল পাণ্ডুলিপিসহ বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ।
মহীয়সী ফাতিমা আল-ফিহরি ৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় এগারো শ বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর বুকে লাখ লাখ বিদ্যান জন্ম দিয়ে চলেছে। হাজার বছরের বিবর্তন সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যে এখনো ফাতিমার নির্মিত সেই ভবনগুলোর ছাপ রয়ে গেছে। ১৯৬৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি আধুনিক মরক্কোর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তবে আধুনিকতার সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি মূল্যবোধ, পাঠদানের ইসলামি পদ্ধতি এবং ইসলাম শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব এখনো বহাল রয়েছে।