প্রক্সি চক্রের অধিনায়ক রাবি ছাত্রলীগ নেতা - দৈনিকশিক্ষা

প্রক্সি চক্রের অধিনায়ক রাবি ছাত্রলীগ নেতা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

হোক সেটা সরকারি চাকরি কিংবা ভর্তি। লিখিত পরীক্ষার মতো কঠিন বাধা ডিঙাতে রয়েছে সহজ সাঁকো! তৈরি আছে প্রক্সি চক্র। শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের 'অধিনায়ক' রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়। শুধু রাবি নয়, কমবেশি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে একজনের পরীক্ষায় অন্যজনকে বসানোর এই জালিয়াতিতে রয়েছে তন্ময়ের হাত। এই ছলনার জন্য তন্ময়কে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, অগ্রণী ব্যাংক রাবি শাখার তন্ময়ের এক হিসাব নম্বরেই গত পাঁচ বছরে ঢুকেছে অন্তত ৪২ লাখ টাকা। এ টাকা দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছে।

গত মঙ্গলবার রাবির স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে ধরা পড়েন তন্ময়ের বন্ধু বায়েজিদ খান। বায়েজিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে ফাঁস করেন চক্রের 'গুরু' তন্ময়ের নাম। তাঁর সেই জিজ্ঞাসাবাদের একটি ভিডিও এরই মধ্যে ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

ওই ভিডিওতে বায়েজিদকে বলতে শোনা যায়, 'তন্ময় তাঁকে এই কাজ (প্রক্সি) দিয়েছেন। তন্ময় এসএম হলের দোতলায় থাকেন।' তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী এসএম (শাহ মখদুম) হলের দ্বিতীয় তলায় থাকা তন্ময় হচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময়। বায়েজিদ দীর্ঘদিন ধরে তন্ময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন চাকরি ও ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতেন। রাবির কয়েক বছরের ভর্তি পরীক্ষা তন্ময়ের প্রক্সি চক্র নিয়ন্ত্রণ করছিল বলে গুঞ্জন থাকলেও এতদিন পাওয়া যায়নি প্রমাণ। বায়েজিদের ওই ভিডিও বার্তার পর এবার তা প্রকাশ্যে এলো। অনেকের ধারণা, শুধু তন্ময় নয়, প্রক্সি চক্রে আরও অনেকে জড়িত থাকতে পারে।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব বলেন, 'তন্ময় রাবিসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্সি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি লোক ভাড়া করে তাঁদের মাধ্যমে প্রক্সি দিয়ে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছেন। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় তাঁর লোকজন অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেন। তাঁর মাদক কারবারও আছে।' রাবি ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী অনিক মাহমুদ বনি বলেন, 'তন্ময় শীর্ষ ইয়াবা কারবারি। তিনি ভর্তি বাণিজ্যের অন্যতম হোতা।

রাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়

লাখ লাখ টাকায় কন্ট্রাক্ট করে তাঁর ভাড়া করা লোক দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করান। এসব নিয়ে খোঁজ করলে প্রভাবশালী অনেকের নাম বেরিয়ে আসবে।'

শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী আমিনুল ইসলাম লিংকন বলেন, 'যে ভিডিও ছড়িয়েছে সেটি সত্যি হলে তাঁর (তন্ময়) বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও নড়েচড়ে বসা উচিত। তিনি বিতর্কিত, তাঁকে কে সুযোগ দিল ছাত্রলীগে? সেটাও খোঁজা দরকার।'

রাবি ছাত্রলীগের আরেক নেতা মেহেদী হাসান মিশু বলেন, 'তাঁর নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। আমি যতটুকু জানি এর আগেও একই অপরাধে তাঁকে একবার ডিবি পুলিশ আটক করেছিল। তবে কোনো মাধ্যমে তিনি বের হয়ে আসেন। তাঁর অঢেল টাকা রয়েছে। এ টাকায় গাইবান্ধায় তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতাল করেছেন বলে শুনেছি।'

ব্যাংক হিসাবে ৪২ লাখ টাকার লেনদেন :তন্ময়ের জ্ঞাত আয়ের কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। তবে তিনি প্রক্সি ও মাদক কারবারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন। সেই টাকায় গাইবান্ধায় একটি প্রাইভেট হাসপাতাল নির্মাণের গুঞ্জন রয়েছে। ২০১৬ সালের ২২ মার্চ রাবির অগ্রণী ব্যাংকে 'মুশফিক তাহমিদ তন্ময়' নামে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন তিনি। শিক্ষার্থী পরিচয়ে ২০০ টাকা জমায় হিসাবটি খোলা হয়। শুরুর দিকে খুব সামান্য লেনদেন করলেও ২০১৭ সালের ৭ মার্চ থেকে গত ১৮ জুলাই পর্যন্ত তাঁর হিসাবে ৪২ লাখ ২৪ হাজার ৭৫৮ টাকা জমা হয়। তবে সব টাকা তিনি তুলে নিয়েছেন। ছাত্র হয়েও তাঁর ব্যাংক হিসাবে এত টাকা জমা থাকার বিষয়টি সংশ্নিষ্টরা খতিয়ে দেখছে।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ৭ মার্চ সুন্দরগঞ্জ থেকে তাঁর হিসাবে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা হয়। একই বছরের ৫ নভেম্বর মাওনা বাজার থেকে ১ লাখ, একই স্থান থেকে ৯ নভেম্বর ৫০ হাজার, ১৩ ডিসেম্বর মনিরামপুর থেকে আজিজ পাঠিয়েছেন ২ লাখ, ২০১৮ সালে পোড়াদহের মাহফুজ ৫০ হাজার, ২৬ এপ্রিল পোড়াদহ থেকে মাহফুজ আলামিন ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা পাঠান। আপেল পাঠান ৫০ হাজার। জলঢাকা থেকে ৪ নভেম্বর ৫০ হাজার টাকা ঢুকেছে তাঁর হিসাবে। ২৮ অক্টোবর ক্যান্টনমেন্ট শাখা থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঢুকেছে। ১৯ নভেম্বর কোটালীপাড়া থেকে ১ লাখ, ২০ নভেম্বর জলঢাকা থেকে ৫০ হাজার, ২২ নভেম্বর সুন্দরগঞ্জ থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা ঢোকে। ২৭ নভেম্বর জলঢাকা থেকে ১ লাখ টাকা, ১১ ডিসেম্বর জলঢাকা থেকে ৫০ হাজার, ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নীলফামারী থেকে ১ লাখ, ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজাপুরহাট থেকে ৬০ হাজার, ১০ এপ্রিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা জমা হয়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ৬০ হাজার টাকা, ১৯ অক্টোবর রমনা থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২৩ ডিসেম্বর আরটিজিএসের মাধ্যমে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০০ টাকা আসে। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর মেডিকেল শাখা ৫০ হাজার, ১৯ নভেম্বর একই স্থান থেকে আরও ১ লাখ টাকা, ২২ নভেম্বর ঠাকুরগাঁও থেকে ৮৫ হাজার, ২০২১ সালের ২ মে সুন্দরগঞ্জ থেকে ৩ লাখ টাকা, ১৯ জুলাই উলিপুর শাখা থেকে ৫০ হাজার ৩০০ টাকা জমা হয়। গত ১২ জুন সুন্দরগঞ্জ থেকে ২ লাখ, ১৪ জুন একই স্থান থেকে আরও ২ লাখ, ২৬ জুন ১ লাখ ১০ হাজার, ২৭ জুন বাস টার্মিনাল থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার, ২৮ জুন একই স্থান থেকে ১ লাখ ২০ হাজার, ১৮ জুলাই সুন্দরগঞ্জ থেকে ১ লাখ টাকা তন্ময়ের হিসাবে ঢোকে। এর বাইরেও আরও অনেক ছোট ছোট অঙ্কের টাকা তাঁর হিসাবে জমা হয়েছে। তবে এই টাকা সঙ্গে সঙ্গে তিনি তুলে নেন। সবশেষ গত ১৮ জুলাই তাঁর হিসাব নম্বরে স্থিতি ছিল মাত্র ৭৫৯ টাকা।

ভাগ যায় অনেক রাঘববোয়ালের কাছে :মুশফিক তাহমিদ তন্ময়ের অবৈধ অর্জন এবং তাঁকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতার বিরুদ্ধে। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার ঘনিষ্ঠও তন্ময়। তন্ময় সেই কেন্দ্রীয় নেতা ও শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কিবরিয়াকে মাসোহারা দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর রয়েছে ঘনিষ্ঠতা। ওই শিক্ষক বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। এ ছাড়া তন্ময় আগামী সম্মেলনে শীর্ষ পদ পেতে কেন্দ্রে দৌড়ঝাপ করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন সংগঠনটির নেতারা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদক কারবারির তালিকায় তন্ময় :২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) ঘিরে গড়ে ওঠা ইয়াবা কারবার চক্রের ৪৪ জনকে শনাক্ত করে একটি প্রতিবেদন দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের মাদক অধিশাখা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া প্রতিবেদনটিতে অবৈধ মাদক কারবারি ও সরবরাহকারী তালিকার ১৬ নম্বরে ছিল তন্ময়ের নাম।

নজরদারিতে তন্ময় :রাবিতে এবারের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয় গত ২৫ জুলাই। ওই দিন রাতে তন্ময় ক্যাম্পাসেই ছিলেন। পরদিন (মঙ্গলবার) প্রক্সি দিতে গিয়ে আটক বায়েজিদ তাঁর নাম বলে দেন। বায়েজিদ আটকের পর তন্ময় ক্যাম্পাস থেকে হাওয়া। মঙ্গলবার থেকে তাঁকে হলেও দেখা যায়নি। দুটি মোবাইল ফোনও বন্ধ। তাই তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এসব বিষয়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং সরকারি সংস্থা তাঁকে খুঁজছে। বায়েজিদের ওই ভিডিও নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। তবে সংশ্নিষ্ট কোনো কর্মকর্তাই এই মুহূর্তে গণমাধ্যমকে কিছু জানাতে রাজি হননি।
প্রক্টর আসাবুল হক বলেন, 'বায়েজিদ একেক সময় একেক নাম বলেছে। প্রথমে সে তার নিজের পরিচয়ও মিথ্যা বলেছে। যেহেতু তন্ময়ের নামটি এসেছে। তদন্ত করে বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে কেউ আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে বিশ্ববিদ্যালয় আইনেও তার বিচার হবে।'

রাবি ছাত্রলীগ সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, 'তার (তন্ময়) বিষয়ে এসব অভিযোগ জানা ছিল না। এখন প্রকাশ হয়েছে। কেন্দ্রের কাছে তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।'
সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, 'আমরা তার (তন্ময়) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করব।'

পুরনো পদ্ধতিতে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা - dainik shiksha পুরনো পদ্ধতিতে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা শিক্ষায় কী হলো তিন মাসে - dainik shiksha শিক্ষায় কী হলো তিন মাসে মাদরাসায় চলে যায় প্রাথমিকের ২৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী - dainik shiksha মাদরাসায় চলে যায় প্রাথমিকের ২৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক অবশেষে কপাল খুললো পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে বাদপড়াদের - dainik shiksha অবশেষে কপাল খুললো পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে বাদপড়াদের শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ১৫তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ১৫তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে গণঅভ্যুত্থানে আহতদের তোপের মুখে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা - dainik shiksha গণঅভ্যুত্থানে আহতদের তোপের মুখে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দপ্তরসহ সাবেক শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রীকে চালাতেন পিয়ন! - dainik shiksha দপ্তরসহ সাবেক শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রীকে চালাতেন পিয়ন! ৬১০ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ চূড়ান্ত! - dainik shiksha ৬১০ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ চূড়ান্ত! দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033140182495117