কুমিল্লার মুরাদনগরে জোর করে এক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগে উঠেছে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় উপজেলা পরিষদ ভবনের ভিতরে এ ঘটনা ঘটে।
জোর করে ওই প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেয়ার একটি ভিডিয়ো এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দেয়া সৈয়দা হাসিনা আক্তার উপজেলা সদরের নূরুন্নাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ওই প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করানো বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বললে তারা অভিযোগ করেন, প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ। তাছাড়া তিনি পরীক্ষার ফিসহ নানান বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়েছেন। তাই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
তবে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেয়ার আগ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো লিখিত দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির বর্তমান সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিন বলেন, কিছু শিক্ষার্থী নূরুন্নাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগপত্র আমার কাছে দিয়ে গেছে। আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।
এদিকে, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ না থাকার পরেও এমন ঘটনা ঘটার নেপথ্যে তিনজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম এখন অভিভাবকদের মুখে মুখে।
বিদ্যালয়টির অভিভাবক সদস্য জাকির হোসেন বলেন, তিন আওয়ামী লীগ নেতা অষ্টম ও নবম শ্রেণির কিছু শিক্ষার্থীকে ভুল বুঝিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
তিনি বলেন, কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর আলম সরকারের আশীর্বাদে এই বিদ্যালয়ের বিদ্যোৎসাহী সদস্য হন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রিপন। প্রভাব খাটিয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মানিক হন অভিভাবক সদস্য।
“কমিটি হওয়ার শুরু থেকে এই দুজন আরেক আওয়ামী লীগ নেতা রিংকুকে সঙ্গে নিয়ে প্রধান শিক্ষক হাসিনা আক্তারকে সরানোর জন্য নানান পাঁয়তারা করে আসছিলেন।”
অভিভাবক সদস্য জাকির আরও বলেন, গত ৫ অগাস্ট দেশে পরিবর্তন আসায় তারা এলাকা ছাড়া। কিন্তু নেপথ্যে থেকে বর্তমান কিছু শিক্ষার্থীকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে তারা।
তার প্রমাণ হলো- প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করতে যে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছে, তার অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতাদের সন্তান। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আছে প্রায় ১৬শ। অথচ অষ্টম ও নবম শ্রেণির ৫০-৬০ শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন।
এসব বিষয়ে জানতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ওই তিন নেতার মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
এদিকে শুক্রবার থেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার ঘটনার একটি ভিডিয়ো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
৯ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের ওই ভিডিয়োতে দেখা যায়, একটি চেয়ারে বসা প্রধান শিক্ষক হাসিনা আক্তারকে ঘিরে রেখেছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কয়েকজন শিক্ষার্থী বারবার তার সামনে তাদের লেখা পদত্যাগ পত্রটি এগিয়ে দিচ্ছেন আর তাতে স্বাক্ষর করতে বলছেন।
কিন্তু প্রধান শিক্ষক তাতে সই করবেন না বলে অটুট থাকেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকে।
ভিডিয়োতে শিক্ষার্থীদের অবরোধের ফলে প্রধান শিক্ষককে শারিরীকভাবেও অস্বস্তিতে ভুগতে দেখা গেছে। পরে শেষ সন্ধ্যার দিকে আলো কমতে শুরু করলে শিক্ষার্থীদের মোবাইল থেকে টর্চ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা এ ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে হাসিনা আক্তার শিক্ষার্থীদের এনে দেওয়া পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। তিনি তাতে স্বাক্ষর করলে শিক্ষার্থীদের হৈ-হুল্লোড় করে উল্লাস করতে দেখা গেছে ভিডিয়োতে।
শুক্রবার প্রধান শিক্ষক সৈয়দা হাসিনা আক্তার বলেন, “বৃহস্পতিবার অষ্টম ও নবম শ্রেণির কিছু শিক্ষার্থী উপজেলা সদরের আল্লাহু চত্বরে জড়ো হয়ে আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে- এমন খবরে বেলা ১২টার দিকে আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়ের কাছে এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তার কার্যালয়ে যাই।”
“কিন্তু ওখানে গিয়ে শিক্ষার্থীরা আমাকে বেরিকেড দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাকে আটকে রেখে তারা জোরপূর্বক আমার কাছ থেকে পদত্যাগের স্বাক্ষর নেয়।”
এই শিক্ষক আরও বলেন, “২০১২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আমার নিয়োগ। এক যুগের বেশি সময় পর আমার বিরুদ্ধে এমন মিথ্যা অভিযোগ আমাকে মানসিকভাবে চরম কষ্ট দিয়েছে।”