মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার বাড়ি পিরোজপুরে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) লোকমান হোসেন মিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ও স্বাস্থ্যসেবাসচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের বাড়িও বরিশালে। এমনকি নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলমও পটুয়াখালীর সন্তান। বুধবার (২৬ এপ্রিল) আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন উবায়দুল্লাহ বাদল।
অর্থাৎ প্রশাসনের শীর্ষ দুটি পদসহ এসব গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের গ্রামের বাড়ি বৃহত্তর বরিশালে। সরকারের সচিব-সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা বা অঞ্চলভিত্তিক বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। করোনা মহামারিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ত্রাণ সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সচিবদের হাতে। তখন অধিকাংশ সচিব পেয়েছিলেন নিজ জেলার দায়িত্ব। যে জেলার সচিব ছিল না, সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অন্য জেলার কর্মকর্তাদের। মূলত তখন থেকেই সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক বিষয়টি আলোচনায় আসে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ বর্তমানে সরকারের সিনিয়র সচিব ও সচিবের সংখ্যা ৮৭ জন। তাঁদের মধ্যে ১৫ জনই চুক্তিভিত্তিক। এতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালকসহ রাষ্ট্রদূতও রয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে ৮৪ জনের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংখ্যাভিত্তিক সবচেয়ে বেশি ৯ জন সচিবের গ্রামের বাড়ি ঢাকা জেলায়। খুলনা জেলায় ছয়জন এবং চট্টগ্রাম জেলায় পাঁচজন সচিবের বাড়ি রয়েছে। বরিশাল ও গাজীপুরে চারজন; কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী ও নেত্রকোনা জেলায় তিনজন করে সচিব রয়েছেন, যাঁরা জন্মসূত্রে সেসব জেলার বাসিন্দা। অথচ প্রশাসনে ২৩টি জেলার কোনো কর্মকর্তা বর্তমানে সচিব পদে নেই।
সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে জেলা কোটার কোনো বিষয় নেই বলে মন্তব্য করেছেন কলামিস্ট ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, প্রশাসনের শীর্ষ এসব পদে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিবেচনায় সচিব করে থাকেন, এখানে আঞ্চলিকতার কোনো বিষয় নেই।
২০০২ সালের সচিব পদে পদোন্নতির বিধিমালায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সচিব পদে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এক বছরের অভিজ্ঞ হওয়ার পর দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অবসরের বয়স হয়ে গেলে এ শর্ত শিথিল করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সচিবালয়ে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। মূল্যায়নে ৮৫ শতাংশ নম্বরও থাকতে হবে।
সচিব/সিনিয়র সচিব ও সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলার কর্মকর্তার মধ্যে সচিব পদে আছেন ২৬ জন। তাঁদের মধ্যে ঢাকা জেলার ৯ সচিব হলেন চুক্তিতে থাকা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনসচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, সেতুসচিব মনজুর হোসেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব ড. নাহিদ রশীদ, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইবরাহিম, খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) আবদুল বাকী, আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন, সংস্কৃতিসচিব খলিল আহমদ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। গাজীপুরের চারজন হলেন বস্ত্র ও পাটসচিব মো. আবদুর রউফ, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান (সচিব) নাসরীন আফরোজ ও চুক্তিতে থাকা রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা। নরসিংদীর তিনজন হলেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগম, লেজিসলেটিভ ও সংসদ সচিব মইনুল কবির ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ।
প্রশাসনে টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে দুজন করে সচিব রয়েছেন। তাঁরা হলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ও চুক্তিতে থাকা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব ওয়াহিদুল ইসলাম খান, এসডিজির মুখ্য সমন্বয়ক মো. আখতার হোসেন, বিটিআরসির চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) শ্যামসুন্দর সিকদার, আইসিটি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণসচিব মো. আজিজুর রহমান। এ ছাড়া ফরিদপুরের পরিসংখ্যানসচিব ড. শাহনাজ আরেফিন; গোপালগঞ্জের চুক্তিতে থাকা গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন; কিশোরগঞ্জের পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ এবং নারায়ণগঞ্জে পানিসম্পদসচিব নাজমুল আহসান রয়েছেন। মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও রাজবাড়ি—এই তিন জেলা থেকে সচিব পদে কেউ নেই।
সচিবের সংখ্যায় ঢাকা বিভাগ এগিয়ে থাকলেও ক্ষমতার দাপটে এগিয়ে বরিশাল বিভাগ। ওই বিভাগের ছয় জেলার সাতজন কর্মকর্তা সচিব পদে কাজ করলেও শুধু বরিশাল জেলারই আছেন চারজন। তাঁরা হলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) লোকমান হোসেন মিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। পিরোজপুরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ঝালকাঠির পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সচিব মু. আবদুল হামিদ জমাদ্দার ও পটুয়াখালীর নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম। ভোলা ও বরগুনা জেলার কোনো সচিব নেই বর্তমান প্রশাসনে।
চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় সচিব পদে কর্মরত আছেন ২০ কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচজন হলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদমর্যাদায় ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ড. আহমদ কায়কাউস, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের চুক্তিতে থাকা সচিব সম্পদ বড়ুয়া, ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়কসচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী এবং বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মু. মোহসিন চৌধুরী। কুমিল্লা জেলার রয়েছেন ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান সিনিয়র সচিব আবুবকর ছিদ্দীক, সুরক্ষাসেবাসচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিনজন সচিব হলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসচিব মো. মশিউর রহমান, চুক্তিতে থাকা বিপিসির চেয়ারম্যান (সচিব) এ বি এম আজাদ এবং আইন ও বিচারসচিব মো. গোলাম সারওয়ার।
দুজন করে সচিব আছেন ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলায়। তাঁরা হলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, তথ্য ও সম্প্রচারসচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিত কর্মকার, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম, নৌপরিবহনসচিব মো. মোস্তফা কামাল, বিদ্যুৎসচিব মো. হাবিবুর রহমান ও চুক্তিতে থাকা ইরাকের রাষ্ট্রদূত (সচিব) মো. ফজলুল বারী। এ ছাড়া কক্সবাজারের সচিব রয়েছেন বিসিএস প্রশাসন একাডেমির রেক্টর (সচিব) মোমিনুর রশিদ আমিন। পার্বত্য তিন জেলার কোনো কর্মকর্তা সচিব পদে নেই।
খুলনা বিভাগের ১০ জেলার সচিব পদে ১০ কর্মকর্তা কাজ করছেন প্রশাসনে। তাঁদের মধ্যে খুলনার ছয়জন হলেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. কামাল হোসেন, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ধর্মসচিব কাজী এনামুল হাসান, রেলসচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর এবং কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার। এ ছাড়া সাতক্ষীরার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) শেখ ইউসুফ হারুন, নড়াইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব খাজা মিয়া, বাগেরহাটে যুব ও ক্রীড়াসচিব ড. মহিউদ্দীন আহমেদ এবং ঝিনাইদহে মহিলা ও শিশুবিষয়ক সচিব হাসানুজ্জামান কল্লোল রয়েছেন। যশোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও মাগুরা জেলার কোনো কর্মকর্তা সচিব পদে নেই প্রশাসনে।
চার জেলার ময়মনসিংহ বিভাগের সচিব পদে কর্মরত আছেন ছয় কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে শুধু নেত্রকোনারই তিনজন। তাঁরা হলেন চুক্তিতে থাকা প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন (সচিব) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) এ কে এম ফজলুল হক ও ইআরডি সচিব শরিফা খান।
ময়মনসিংহের রয়েছেন প্রবাসীকল্যাণসচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন ও সংস্কৃতিবিষয়ক সচিব মো. আবুল মনসুর। এ ছাড়া জামালপুরের মো. কামরুল হাসান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব হিসেবে কাজ করছেন। শেরপুর জেলার কোনো কর্মকর্তা সচিব পদে নেই প্রশাসনে।
একইভাবে সিলেট বিভাগের চার জেলায় সচিব পদে আছেন তিন কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে সিলেটের দুজন বিপিএটিসির রেক্টর (সচিব) মো. আশরাফ উদ্দিন ও শ্রমসচিব মো. এহসানে এলাহী। মৌলভীবাজারের মো. মোকাব্বির হোসেন রয়েছেন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (সচিব) পদে। হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের কোনো সচিব নেই।
রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় আটজন সচিব রয়েছেন প্রশাসনে। তাঁদের মধ্যে সিরাজগঞ্জের দুজন হলেন চুক্তিতে থাকা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও সংসদ সচিবালয় সচিব কে এম আবদুস সালাম। পাবনার দুই সচিব হলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলাম। বগুড়ার দুই সচিব হলেন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন ও পিপিপির সিইও (সচিব) ড. মুশফিকুর রহমান। রাজশাহী ও নাটোর জেলার একজন করে সচিব হলেন জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির ডিজি সুকেশ কুমার সরকার এবং শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা। জয়পুরহাট, চাপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর কোনো সচিব নেই প্রশাসনে।
রংপুর বিভাগের আট জেলায় চারজন সচিব রয়েছেন। তাঁরা হলেন কুড়িগ্রামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান, নীলফামারীর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম, রংপুরের সমাজকল্যাণসচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং গাইবান্ধার ভূমিসচিব মো. খলিলুর রহমান। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাটের কোনো সচিব নেই বর্তমান প্রশাসনে।